মলয় রায়চৌধুরীর ছোটগল্প : আওয়ার লেডি অফ দি জিজুয়া

স্কুলে ভর্তি হইয়াছিলাম অত্যন্ত অল্প বয়সে, জনৈক পাদ্রির বদান্যতায়, তাঁহার নাম ফাদার হিলম্যান, সম্পূর্ণ নাম জানা হয় নাই, কী করিয়াই বা জিজ্ঞাসা করিব যে, ফাদার আপনার নাম কি । তিনি জার্মানি হইতে ভারতে আসিয়াছিলেন, তাহা তিনি আমার পিতৃদেবকে একদা বলিয়াছিলেন, এবং ভারতের বৈচিত্র্য ও বৈভিন্ন্যের বহুমাত্রিকতা তাঁহাকে অত্যন্ত মুগ্ধ করিয়াছিল ; তিনি মনে করিতেন যে এই দেশ সূর্যরশ্মির সাতটি রঙের বিস্ফোরণ হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে  । পাদ্রিসাহেবকে প্রথমবার দেখিয়া আমি অবাক হইয়া গিয়াছিলাম, কেননা তৎপূর্বে এই প্রকার ধবলত্বক মানুষ আমি দেখি নাই । তাঁহার দেহ একটি শ্বেত বস্ত্রে ঢাকা, কেবল মুখ ও দুইটি হাত কনুই হইতে ঢাকা নহে। এইরূপ পোশাকও পূর্বে দেখি নাই ।

গীর্জার যাযক ফাদার হিলম্যান তাঁহার মুগ্ধতাকে জাগতিক রূপ দিবার নিমিত্ত  ফোটো তুলিতে ভালোবাসিতেন । সেসময়ে ডিজিটাল ক্যামেরা ও হাই রেজোলিউশান ফোটোগ্রাফি আবিষ্কার হয় নাই। কাঁচকড়ার রোল ফিল্মে ফোটো তোলা হইত, এবং একটি ফিল্মে বারোটি অথবা ষোলোটি ফোটো তোলা যাইত । কাঁচকড়ার ফিল্মটি  অন্ধকার ঘরে রক্তবর্ণ আলো জ্বালাইয়া, রসায়নে চোবাইয়া প্রস্ফূটিত করা হইত, এবং তাহা শুকাইয়া গেলে সেই অন্ধকার ঘরে সেগুলি হইতে ফোটোগ্রাফির কাগজের উপর প্রিন্ট করা হইত । অজস্র ফোটো তুলিতেন তিনি, এবং ফোটোগ্রাফির সূত্রেই পিতৃদেবের সহিত তাঁহার পরিচয় । অজস্র ফোটো তুলিতেন বলিয়া প্রায়ই পিতৃদেবের সন্নিকটা আসিতেন ও কোথায় কী তাঁহাকে অবাক করিয়াছে তাহার গল্প করিতেন ।

পিতৃদেবের কৈশোরে তাঁহার পিতা, অর্থাৎ আমার পিতামহ, হৃদরোগে আক্রান্ত হইয়া  দেহত্যাগ করিয়াছিলেন । পিতৃদেব এবং তাঁহার ভাইবোনগণ কেহই স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ পান নাই । পিতামহ ফোটোগ্রাফি ও ছবি অঙ্কনের একটি ভ্রাম্যমাণ সংস্হা স্হাপন করিয়াছিলেন, এবং তৎকালীন রাজা ও নবাবদিগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজপরিবারের সদস্যদিগের ফোটো তুলিয়া তৈলচিত্র অঙ্কনের উদ্দেশে বিভিন্ন রাজদরবারের অতিথিরূপে এক-একটি শহরে সপরিবারে আশ্রয় লইতেন, এবং বহুদিবস অতিথিরূপে অতিবাহিত করিতেন । পিতৃদেব ও ভাইগণের যেটুকু পড়াশুনা, তাহা রাজপরিবারের শিক্ষকদের অবদান । বাংলা ভাষার তুলনায় তাঁহারা ইংরেজি ও ফার্সিতে সড়গড় হইয়াছিলেন ।

পিতৃদেবের নিকট তাঁহার জীবনের বহু আকর্ষণীয় কাহিনি শুনিয়াছি । তাঁহাদের আতিথ্য সম্পর্কিত, খাদ্য ও ভ্রমণ সম্পর্কিত । এক্ষণে যাহাকে পাকিস্তান বলা হইয়া থাকে,  পিতামহ ও ভাইগণের সহিত তিনি তথাকার প্রতিটি রাজ্যে নবাব ও রাজাগণের আতিথ্য লইয়াছিলেন এবং রাজপরিবারের বিলাসিতা তাঁহাদের উপরও কিঞ্চিদধিক বর্ষিত হইত । কিন্তু পিতামহের মৃত্যুর কারণে আমরা অকস্মাৎ আর্থিক দারিদ্র্যে আক্রান্তি হইয়াছিলাম, শেষে ভাইগণ পাটনা শহরের মহাদলিতগণের পাড়ায় আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিল ।

ফাদার হিলম্যানের সহিত ইংরেজিতে বার্তালাপ করিতে পিতৃদেবের অসুবিধা হইত না । কোনো এক দিবসে পিতৃদেব আমাকে তাঁহার স্টুডিও-দোকানে লইয়া গিয়াছিলেন । ফিল্মের কাঁচকড়া মুড়িবার যে লাল কাগজ থাকিত, তাহাকে লাঠির মতো পাকাইয়া দিয়াছিল রামখেলাওন সিং ডাবর, বাবার স্টুডিও-দোকানের কাজের লোক । আমি সেই লাঠিটিকে তরোয়ালের ন্যায় আমার চারিধারে ঘুরাইতে ছিলাম ও অদৃশ্য শত্রুদিগকে অসিযুদ্ধে পরাজিত করিতে ছিলাম । অকস্মাৎ ফাদার হিলম্যান স্টুডিও-দোকানে প্রবেশ করিলে, তাঁহার দিকেও অসি চালনা করিলে, ফাদার হিলম্যান পিতৃদেবকে প্রশ্ন করিলেন, এই বালকটি কি আপনার সন্তান , এখনও স্কুলে দেন নাই কেন, এই বয়সে যাহা শিখিবে তাহা সম্পূর্ণ জীবন স্মরণে রাখিতে পারিবে ।

ফাদার হিলম্যান ও পিতৃদেবের পরস্পরের কথোপকথন আমি তৎক্ষণে বুঝিতে পারি নাই, কিন্তু রাত্রে খাইতে বসিয়া পিতৃদেব মাকে যাহা বলিয়াছিলেন তাহা এইরূপ:-

পিতৃদেব ফাদার হিলম্যানকে কহিলেন, এতো কম বয়সে কি স্কুলে ভর্তি লয় ? দুই বৎসর পর দিব মনস্হ করিয়াছি, আমার প্রথম পুত্র যে সরকারি স্কুলে শিক্ষালাভ করিতেছে, সেই স্কুলেই দিব, তথায় এতো কম বয়সের বালকদের ভর্তি লয় না ।

ফাদার কহিলেন, আপনি আমার স্কুলে এই বালককে ভর্তি করিয়া দিতে পারেন, আমাদের স্কুলে একটি প্রাথমিক ক্লাস আছে, আপনার সন্তানের বয়সী বালক-বালিকাদের জন্য ।

পিতৃদেব কহিলেন, আপনাদের ক্যাথলিক স্কুলের মাসান্তিক ফিস তো আমি গণিতে পারিব না, আমাকে আমার ভাতৃগণের সংসারও প্রতিপালন করিতে হয় ।

ফাদার পিতৃদেবকে কহিলেন, আমি ওই স্কুলের সর্বময় কর্তা, ফিস মুকুব করিবার বন্দোবস্ত করিব, আপনি নামমাত্র টাকা দিয়া উহাকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করিয়া দিন । কল্য আপনার ছেলেটিকে সঙ্গে লইয়া নয়টার সময় আসিবেন, দরখাস্ত পূরণ করিয়া কর্ম সমাধা করিলে কল্য হইতেই ক্লাস করিতে পারিবে ।

পরের দিন পিতৃদেবের সহিত ক্যাথলিক স্কুলে গিয়া ভর্তি হইয়া গেলাম । ফাদার হিলম্যানের ঘরের ছাদ বহু উচ্চ এবং চারিদিকের প্রতিটি দেয়ালে বিশালাকায় তৈলচিত্র, দেখিয়া মনে হইল চিত্রগুলি সন্তদিগের, যাহাদের গল্প বড়োজ্যাঠাইমা সন্ধ্যাবেলায় লন্ঠনরশ্মির চারিধারে বসিয়া শোনাইয়া থাকেন । সকলেই আলখাল্লা-পরা মানুষ, দাড়ি রহিয়াছে, মাথার পিছনে গোল রশ্মি । বিশাল ঘরটি তাঁহার একার ; আমরা যে গৃহে বসবাস করি তাহার দ্বিতলের সবকয়টি ঘরের ক্ষেত্রফল এই ঘরটির মাপের হইবে ।

স্কুলে প্রবেশ করিবার পর সিংহদ্বারের সন্মুখেই একটি শ্বেতপাথরের মূর্তি দেখিয়াছিলাম, জনৈক মা তাঁহার সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে লইয়া বসিয়া আছেন, তাঁহার পিছনে লম্বা-দাড়ি একজন মানুষ, গায়ে আলখাল্লা, পায়ের নিকটে দুইটি মেষ শাবক লইয়া , দাঁড়াইয়া আছেন । সিংহদ্বার হইতে ভিতরে প্রবেশ করিবার পর, দক্ষিণ দিকে বিশাল সবুজ মাঠ, বালক বালিকারা খেলা করিতেছে, তাহাদিগের মধ্যে বেশ কয়েকজন ফাদার হিলম্যানের ন্যায় ধবলত্বকের বালক ও বালিকা, চুলগুলি স্বর্ণবর্ণ । বাম দিকে একটি ফুলের বাগান, বালক বালিকারা কেহই ফুলগুলি তুলিতে আগ্রহী নহে । আমার পাড়ার বালকেরা যদি এই ফুলগুলি দেখিত তাহা হইলে তৎক্ষণাত তুলিয়া পূজার জন্য বাড়ি লইয়া যাইত অথবা মন্দিরের সামনে বসিয়া বিক্রয় করিত।

ঢং ঢং করিয়া কয়েকবার কাঁসরের ন্যায় ঘণ্টা বাজিলে, বালক বালিকারা বিভিন্ন ঘরের দিকে দৌড়াইয়া চলিয়া গেল, নিমেষে মাঠ ফাঁকা ।

পিতৃদেব আমাকে কহিলেন, ভালো করিয়া ক্লাস করিবে, দ্বিপ্রহরে স্টুডিও-দোকানের কাজের লোক রামখেলাওন সিং ডাবর টিফিন লইয়া আসিবে, তাহা ভক্ষণ করিয়া লইও, কল্য হইতে স্কুলে আসিবার সময়ে তুমি নিজের সঙ্গে টিফিন লইয়া আসিবে । স্কুল ছুটির সময়ে দ্বারপ্রান্তে ডাবর তোমার জন্য অপেক্ষা করিবে, তাহার সাইকেলে বসিয়া গৃহে ফিরিও ।

যে ক্লাসঘরে আমাকে লইয়া যাওয়া হইল, তথায় বালক বালিকারা সকলেই আমার বয়সী ; আমার চেয়ে কম বয়সীও রহিয়াছে কয়েকজন । আমি অদ্য প্রথম ক্লাস করিতেছি বলিয়া ক্লাসের শিক্ষিকা আমার নিকটে আসিয়া নিচু হইয়া আমার মুখের নিকট মুখ আনিয়া কিছু প্রশ্ন করিলেন, ইংরাজি প্রশ্নের কিছুই বুঝিতে পারিলাম না ; তিনি আমার হস্তা কয়েকটি কার্ড দিলেন, যাহাতে সন্তদিগের ছবি এবং তুষারের ভিতর দিয়ে হরিণের যান লইয়া একজন লালপোশাক বৃদ্ধ, শাদা দাড়ি, ছুটিয়া চলিয়াছে । ইহার পর তিনি আমাকে কয়েকটি গ্রন্হ দিলেন, একটিকে গ্রন্হ বলা চলে অন্যগুলি পুস্তিকা, ইংরেজি অক্ষর সম্বলিত ।

ক্লাসের শিক্ষিকাও ধ্ববলত্বক, কেবল তাঁহার মুখ দেখা যাইতেছে । পোশাককে এতো বেশি শ্বেত কি করিয়া রাখেন বুঝিয়া পাইলাম না । আমার মা কাপড় কাচেন, সোডা দিয়া কাচিলেও শ্বত বস্ত্র এতো বেশি শ্বেত হয় না । শিক্ষিকা আমার মুখের নিকটা তাঁহার মাথা নামাইয়া আনিলে, তাঁহার গভীর দৃষ্টিতে অভয় দর্শন করিয়া আশ্বস্ত হইলাম ।

ক্রমে স্কুলে কার্যক্রমে অভ্যস্ত হইয়া গেলাম । আমার ন্যায় একটি বালিকা ইংরেজি জানিত না, সে ফিসফিস করিয়া বাংলায় বলিয়াছিল যে সুযোগ পাইলে আমরা দুইজনে লুকাইয়া বাংলায় কথা কহিব, ইংরেজি শিখিয়া গেলে তৎক্ষণে ইংরেজিতে বার্তালাপ করিব । আমি একজন বন্ধু পাইলাম । প্রতিদিন দ্বিপ্রহরে আমরা আমাদের জলখাবার দুইজনে অর্ধেক বিনিময় করিয়া লইতাম । তাহার খাদ্যবস্তু দেখিয়া বুঝিতাম সে কোনো ধনী গৃহের সন্তান ; তদ্যপি আমার টিফিন খাইতে তাহার আনন্দ হইত, বলিত যে এইপ্রকার স্বাদু খাবার সে খায় নাই ।

প্রথম সপ্তাহের পর একটি আনন্দের ঘটনা ঘটিল । ফাদার হিলম্যান আমাদের সবাইকে বলিলেন গ্রন্হের মতো দেখিতে যাহা, তাহা লইয়া অন্য একটি ক্লাসে শিক্ষণের জন্য যাইতে হইবে । আমাদিগের সকলকে তাঁহার পিছন-পিছন লইয়া চলিলেন স্কুল সংলগ্ন একটি বিশাল অট্টালিকায়, তাহার গম্বুজ অতিউচ্চ । ভিতরে প্রবেশ করিয়া অবাক হইয়া গেলাম । একটি দালানঘর, দুই পাশে বসিবার বেঞ্চ ও তাহার সামনে টেবিলের ন্যায়, ঝকঝকে পালিশ করা  । সন্মুখে একটি পাথরের মূর্তি, একজন মানুষের দুই হাত দুইদিকে করিয়ে পেরেক দিয়া কাষ্ঠখণ্ডে পোঁতা হইয়াছে, তাহার পদদ্বয়ও সেইরূপে পেরেকে বিদ্ধ করা হইয়াছে, আরেকটি লম্বালম্বি কাষ্ঠখণ্ডে ।

আমাদিগকে আশ্বস্ত করিয়া ফাদার হিলম্যান প্রথমে ইংরেজিতে কিছু বলিয়া কহিলেন যে উনি ইরেজিতে যাহা কহিবেন তাহাকে হিন্দিতেও বলিবেন । বড়োই আনন্দ হইল । উনি বলিলেন যে প্রতিদিন একটি ক্লাস হইবে যাহার নাম বাইবেলের গল্পের ক্লাস । যে গ্রন্হটি আমাদের দেয়া হইয়াছে তাহাতে বাইবেলের কয়েকটি গল্প রহিয়াছে, এবং তিনি সেইগুলিই শোনাইবেন । যাঁহাদের গল্প তিনি বলিবেন তাঁহাদের তৈলচিত্র এই গীর্জাঘরটিতে আছে । ইংরেজিতে এই ঘরটিকে বলে চার্চ এবং হিন্দিতে গির্জাঘর ।

পোশাকহীন যে মানুষটিকে কাষ্ঠখণ্ডে পেরেক দিয়া ঝুলাইয়া রাখা হইয়াছে, তাহার গল্প দিয়া তিনি আরম্ভ করিলেন । কাষ্ঠখণ্ডে ঝুলাইবার পূর্বে তাঁহাকে ঐ ভারি কাষ্ঠখণ্ড বহু পথ পরিভ্রমণ করিয়া বহন করিতে হইয়াছিল, তাঁহাকে শান্তির ধর্ম প্রচারের জন্য ঐরূপ শাস্তি প্রদান করা হইয়াছিল । যে কাষ্ঠখণ্ডে তিনি বিদ্ধ তাহার নাম ক্রস এবং যাঁহাকে বিদ্ধ করা হইয়াছে তাঁহার নাম জিজাস খ্রাইস্ট ।

আমাদের গৃহে বহু কাষ্ঠখণ্ড আছে যাহা প্যাকিং বাক্সের রূপে পিতৃদেবের স্টুডিও-দোকানে প্রায়ই বিক্রয়ের সম্ভার লইয়া ভারতের বিভিন্ন স্হান হইতে আসে । প্যাকিং বাক্স খুলিয়া বিক্রয়ের দ্রব্যাদি স্টুডিও-দোকানে রক্ষিত হয় এবং প্যাকিং বাক্স হইতে পেরেকগুলি খুলিয়া রাম খেলাওন সিং বিক্রয় করে, নিজ খইনি খাইবার দাম সংগ্রহের নিমিত্ত । কাষ্ঠখণ্ডগুলি ক্রয়ের জন্য কয়েকমাস অন্তর ক্রেতা আসিলে তাহাকে বিক্রয় করিয়া জঞ্জাল পরিষ্কৃত হয় ।

জিজাস খ্রাইস্টের জীবনকাহিনীতে উৎসাহিত হইয়া স্কুলের ছুটির পর গৃহে প্রত্যাবর্তনান্তে  বৈকাল বেলায় দুইটি কাষ্ঠখণ্ডকে দড়ি দিয়া বাঁধিয়া ক্রস তৈয়ারি করিয়া লইলাম, পাড়ায় পথে বাহির হইলে সমবয়সী বালক-বালিকাগণ জানিতে চাহিল ইহা কী বস্তু, কোনো নূতন ধরণের খেলা ? বলিলাম, ইহা কাঁধে লইয়া পথে-পথে ভ্রমণ করিতে হয় এবং যাহারা পিছনে আসে তাহারা চিৎকার করিয়া জনগণকে সংবাদ জানাইতে থাকে ।

পাড়ার বালক অথবা কিশোর ফুটবল দল জিতিয়া ফিরিলে যদ্রুপ ‘হিপ হিপ হুররে’ চিৎকারধ্বনিতে উল্লাস প্রকাশিত হয়, আমার পিছনের বালক-বালিকাগণ তদ্রুপ ‘হিপ হিপ হুররে’ চিৎকার করিতে লাগিল । আমি পাড়ার বিভিন্ন গলির ভিতর দিয়া পরিক্রমা করিতে লাগিলাম ।

বিরজুর মা, যিনি ছোলাভাজা বিক্রয় করিয়া জীবন অতিবাহন করেন, তাঁহাকে দেখিলাম গালে হাত রাখিয়া অত্যন্ত দুঃখী মুখে চুপচাপ বসিয়া আছেন । তাঁহার মাটির গৃহের দ্বারপ্রান্তে বসিয়াছিলেন । ইহা তো বিরজুর মায়ের ছোলা বিক্রয়ের সময় । কাষ্ঠখণ্ডের ক্রস কাঁধ হইতে মাটিতে নামাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কী হইয়াছে, বিরজু কি আবার কোনো অপকর্ম করিয়াছে ?

বিরজুর মা কহিলেন, বিরজুকে আবার পুলিশ ধরিয়া লইয়া গেছে ; চুরি করিতে গিয়া ধরা পড়িয়া গিয়াছিল, এক্ষণে গৃহে কাষ্ঠ নাই যে আগুন ধরাইয়া ছোলা ভাজিব ।

তাঁহার কথা শুনিয়া আমি আমার ক্রস মাটি হইতে তুলিয়া বিরজুর মাকে দিয়া দিলাম । উনি প্রশ্ন করিলেন, ইহা কী বস্তু, তুই  কী লইয়া খেলা করিবি ।

আমি বলিলাম, ইহা জিজাস খ্রাইস্টের কাষ্ঠখণ্ড, তিনি মহাপুরুষ ছিলেন, স্কুলে শিখাইয়াছে ; বিরজুকে পুলিশ যতদিবস ধরিয়া রাখিবে, আমি বৈকালে পরিক্রমার পর একটি করিয়া ক্রস তোমাকে আনিয়া দিব ।

বিরজুর মা আমাকে জড়াইয়া ধরিলেন ও আদর করিয়া কহিলেন, তুইই আমার জিজুয়া মহাপুরুষ ।

বুঝিতে পারিলাম স্হানীয় ভাষায় নামের সংক্ষিপ্তকরণ প্রক্রিয়া প্রয়োগ করিয়া বিরজুর মা জিজাস খ্রাইস্টকে জিজুয়া নামে অভিহিত করিয়াছেন ।

বিরজু গৃহে প্রত্যাবর্তনের দিন পর্যন্ত আমি প্রতিদিন বৈকালে ছোলাউলিকে দুইটি করিয়া কাষ্ঠখণ্ড দিয়াছি, এবং  জিজুয়া মহাপুরুষরূপে আদৃত হইয়াছি ।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

মলয় রায়চৌধুরীর গল্প : তমে কেবি ছে ? সরস !

       “দ্যাখো, দ্যাখো, ওই তো টিভিতে শাহেনশাহের ঘোষণা পড়ে শোনাচ্ছে মোটোভাই । ক’দিন ধরে খবরের কাগজেও দিচ্ছে, সুযোগটা আমাদের নেয়া দরকার, সংসারের যা অবস্হা, তোমার চাকরি চলে গিয়ে”। স্বামী যতীনকে বলল অমৃতা ।

        “আরে শাহেনশাহ আর মোটোভাইয়ের কথা বাদ দাও তো, সকলের অ্যাকাউন্টে আপনা থেকে টাকা আসবে বলেছিল শাহেনশাহ, উলটে আমাদের ব্যাঙ্কটাই লাটে উঠে গেল।” বলল যতীন।

        “ফোন করে দ্যাখোই না, পাড়ার নিতাইরা তো বাড়ির সবাইকে নিয়ে ট্রাই করতে গেছে, নিশ্চয়ই পুরস্কার নিয়ে ফিরবে, দলে দলে লোক যাচ্ছে, সারা রাজত্বে সাড়া পড়ে গেছে।” বলল অমৃতা ।

        “তুমিই ফোন করো, আমার তো মেজাজ খিঁচিয়ে থাকে, মুখ ফসকে যা-তা বলে ফেলবো, আর মোটাভাই চটে যাবে, ওর স্যাঙাতরা চটে গেলে আরও বিপদ ।” বলল যতীন ।

        টিভিতে, খবরের কাগজে ফোন নম্বর দেয়া ছিল । মোবাইলে নম্বর আগেই সেভ করে রেখেছিল অমৃতা। ফোন করতেই ওদেক থেকে গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে এলো, “আরে আম্রুতবেন, কেম ছে ?”

       অমৃতা মোটা ভাইয়ের গলার আওয়াজ টিভিতে অনেকবার শুনেছে, টেলিফোনে ওনার কন্ঠস্বর শুনে ভাবল বোধহয় আনসারিঙ মেশিনে রেকর্ড করা ; কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে মোটাভাই ওর নাম জানল কেমন করে। অমৃতার ভাবনার মাঝেই মোটাভাইয়ের প্রশ্ন শোনা গেল, “যতিনভাই কেবা ছে ?” মানে, যতীনভাই কেমন আছেন ? আরও অবাক হল অমৃতা, ভয়ও পেল । মোটাভাই যদিও মোটা কিন্তু মোটাভাইয়ের ভাষায় মোটাভাই মানে বড়দা ; ওনার একটা আসল নাম আছে বটে কিন্তু উনি শাহেনশাহের এতো কাছের লোক, এতো বেশি কাছের যে উনি চান লোকে শাহেনশাহের জয়ধ্বনি করুক, ওনার নয় ।

      “তমে আপনে ভায়ো ছো ?” আপনি আমাদের চেনেন ? অবাক হল অমৃতা । শাহেনশাহের রাজত্বে কোটি কোটি লোক অথচ বেছে বেছে শুধু ওদেরই চেনেন ? শাহেনশাহের লোকেরা ওদের দুজনের ওপর লক্ষ্য রাখে নাকি ?

      “হু বদানে জানুঁ ছুঁ”, বলল মোটাভাই । 

      “আরে উনি আমাদের চেনেন, আমার নাম জানেন, তোমার নাম জানেন, জিগ্যেস করছিলেন তুমি কেমন আছো, উনি এমনকি বললেন শাহেনশাহের রাজত্বে সবাইকে চেনেন উনি ।” অমৃতা উত্তেজিত হয়ে যতীনকে বলল। তারপর বলল, “তুমি ওনার সঙ্গে কথা বলে দ্যাখো, বলো যে আমরাও শাহেনশাহের প্রশংসা-রচনায় অংশ নিতে চাই, নয়তো উনি ভাববেন, স্বামী কথা বলছে না কেন, বউকে দিয়ে বলাচ্ছে।”

      রাগ হল যতীনের, বলল, “আরে রচনা লেখা নিয়ে তো কথা, দুজনেই যাবো, তুমিও যাবে, তাতে স্বামী-স্ত্রীর কে কথা বলল বা বলল না, তা নিয়ে শাহেনশাহ নিজে বা মোটাভাই কেউই চিন্তা করেন না। যাকগে, বলছ যখন, দেখি কথা বলে।”

      “প্রণাম মোটোভাই ছে”, বলল যতীন, বউয়ের কাছ থেকে যেটুকু শিখতে পেরেছে দুচারটে কাজ চালানো বাক্য । তারপর জিগ্যেস করল, “মোটোভাই, হুঁ মাত্রভাসামাম লাখি সাকুন ছুঁ?” 

      এই কথাটা বলতে শুনে অমৃতা বলল, “এটা জিগ্যেস করে ভালো করলে, আমাদের ইংরেজি তো সেই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সময়কার, আর মোটাভাইয়ের ভাষাতেও তেমন করে লিখতে পারবো না, মাতৃভাষায় তো তুমি ফাটিয়ে দিতে পারবে, কতো পুরস্কার আর সম্বর্ধনা পেয়েছো এতোকাল, এবার কিছু রোজগারপাতি হোক।” মুচকি হাসি দিয়ে অমৃতার কথা অনুমোদন করল যতীন ।

    “তমারে কয়ারে আভাভুঁ ছে ? তারিখা আপো ।” বলল মোটোভাই, মানে, তোমরা কবে আসবে, তারিখ জানিয়ে দিও।

    “আপানে আজই যাইসুঁ”, বলল যতীন, যতো তাড়াতাড়ি যোগ দিয়ে পুরস্কার জিতে নেয়া যায় ততোই সুবিধে। শেষে সোনার ভাঁড়ার ফুরিয়ে গিয়ে শুধু রুপোর আর লোহার ভাঁড়ার থেকে যাবে ।

     “ঠিক ছে, আজে আভো, ত্যায়ে ঘানুম সোনুঁ আনে চাঁদি ছে।” আশ্বস্ত করলেন মোটোভাই, সোনারুপোর অনেক স্টক আছে ।

      পুরস্কারের তালিকা বেশ লোভনীয় । শাহেনশাহের পছন্দ হলে তিরিশ কিলো করে সোনা দেয়া হবে, যার প্রশংসা সামান্য ভালো লাগবে তাকে দেয়া হবে তিরিশ কিলো করে রুপো, আর যার প্রশংসা খারাপ লাগবে তাকে দেয়া হবে কুড়ি কিলো করে লোহা ।

      আগে একজন বাঙালি পুরস্কার জিতেছে, তার নাম প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু তার রচনাটা খবরের কাগজে, পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, সুন্দরী পাঠিকা তা টিভিতে পড়েছে, সুকন্ঠী পাঠিকা তা রেডিওতে শুনিয়েছে । 

     অমৃতা কাগজের কাটিঙটা নিয়ে এলো, যাতে ধারণা করে নেয়া যায়, কেমন প্রশংসা-রচনা লিখতে হবে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রিভাইজ করে নিল গদ্যটা, যদিও এর আগে উচ্চমাধ্যমিকের মতন বার বার পড়েছে । অমৃতা রচনাটা জোরে-জোরে পড়তে লাগল আর যতীন চোখ বুজে শুনতে লাগল প্রথম পুরস্কার পাওয়া রচনা, মগজে ঝকমক করতে লাগলো পনেরো কিলোর এক-একটা সোনার ফুটবল :

ভাবসো আমি কিছু বুজিনা? আমি খুব মিউমিউ কইরা কইলাম, ভাবি গো ছয় দিন হইলো বিছনায় পইড়া আছি। ওষুধ চলে, খুব ঘুম আসে, ঘুম আইলেই ভাইঙ্গা যায় পাখপাখালির আওয়াজে।তুই আর নেই!!!!ভাবতেই পারছি না, কি থেকে কি হল রে, অভিমান ছিল জানি। এই তো সেদিনও কথা হোলো, বাড়ি করবি বলছিলি, তাই বলে এমন জায়গায় বাড়ি করলি রে দীপান্বিতা… সবসময় হাসিমুখটা খুব মনে পড়ছে রে, মন তোর জন্য ভালো নেই।বেসিক্যালি আপনার কোনো বন্ধু নেই। আপনি পেঁচার মতো মুখ করে থাকলেও কেউ বিশ্রীরকম জোক করে আপনাকে জ্বালাতন করার নেই। স্কুলের বন্ধুদের যারা নাগালে আছে তাদের ফোন রিঙ হয়ে যাবে। পকেটে তিরিশটাকা পড়ে থাকবে যা দিয়ে একটা নিপও হয় না। অনেক ভেবে পুরোনো এক নেশাখোরকে ফোন করলে দেখবেন সে অসুস্থ এবং তার মা ফোন রিসিভ করে আপনার কুশল সংবাদ নিচ্ছে। পৃথিবীর যাবতীয় বন্ধু ভাবাপন্ন সম্পর্কগুলো সময়ের সাপেক্ষে বদলে গেছে। এবং আপনার একমাত্র বন্ধু, আপনার প্রেমিক ড্যাং ড্যাং করে অনুমতির তোয়াক্কা না করেই মরে গেছে। এবং আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না আপনি ঠিক কী কেশোৎপাটিত করছেন। তাকে বলে বাঁশ। সবকা বাপ। এই সময়ে ঘরে কিচ্ছু নেই। না মদ, না তামাক, না ওষুধ ;যেখানে থাকিস ভালো থাকিস রে….দীপু.. বেশি না খালি সালাউদ্দিনরে সরায়া আর ৪০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ কইরা (স্টেডিয়াম ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ, কোচ প্রশিক্ষন, বিজ্ঞাপন আর বিপনন ) খেলাটারে বিলিয়ন ডলার ব্যবসার জায়গা বানানো যায়। তাও মাত্র পাঁচ বছরে। পরিমান মত রান্নায় স্বাদ হয় বেশ, মহাকাব্যে আছে অতিদর্পে শেষ। ক্লাব ফুটবলে চল্লিশটা দলকে অনুদান (স্বল্প সুদে ঋণ, শেয়ার বিক্রি) দেন। হিড়িম্বা মন্দির ।ভালো লাগলো,হিড়িম্বা অর্থাৎ মহাভারতের ভীমসেনের ঘরনির নামে মন্দির আছে।অন্য কাস্টের হওয়ার দরুণ মা কুন্তী তাঁকে পরিবারে ঠাঁই দেননি, ঘটৎকচ যুদ্ধে প্রাণ দিলেন, বংশের পুত্র।নিঃসঙ্গ হিড়িম্বার স্মৃতি চিহ্ণ দেখে সত্যি ভালো লাগলো। কড়া অডিটের ব্যবস্থা করেন যাতে টাকা মাইরা যাইতে না পারে।

      “দারুন লিখেছে”, চোখ খুলে বলল যতীন। মিটিমিটি হেসে অমৃতা বলল, আমি তো লিখে অনেকবার প্র্যাকটিস করে নিয়েছি ।

           রচনাকেন্দ্রে দুজনে পৌঁছে দেখলো প্রচুর ভিড়, নামের তালিকা দেখে ওরা নিজের-নিজের সিটে গিয়ে বসল। দুজনে গুডলাক বলে হাই ফাইভ করে নিলো । সবায়ের টেবিলের ওপরে কমপিউটার । অমৃতা আর যতীন চেক করে নিশ্চিন্ত হয়ে নিল যে বাংলা ফণ্ট আছে । ওদের দুজনের মগজেই রচনার খসড়া কিরকির করছিল । বাঁশি বাজতেই ঝটাপট লিখে ফেলল । মোটোভাইয়ের স্যাঙাতরা এসে বলে গেল দশ  মিনিটেই রেজাল্ট ঘোষণা করা হবে কেননা গ্রেডিঙ ব্যাপারটা শাহেনশাহের পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী আরটিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের মাপকাঠি দিয়ে তৈরি । 

           যে চব্বিশজন তিরিশ কিলো করে সোনা পাবে তাতে অমৃতা আর যতীনের নাম ছিল । শুনে ওরা দুজনে আহ্লাদে আটখানা । যারা রুপোর ফুটবল পেলো, তাদের মুখেও হাসি । গোমড়ামুখে বসে রইলো লোহার ফুটবল পাওয়া জনগণ ।

             অমৃতা এই রচনাটা লিখেছিল :

ওদের কান নেই, শোনেনি আমার ডাক। এঁর এককালে টিউশনের রমরমা বাজার ছিল আমাদের স্কুলে। কানিং এবং বাতেলাবাজ হিসেবেই পরিচিতি ছিল। মুশকিল হচ্ছে, বাতেলাবাজ টিচারদের ছাত্ররা খুউব পছন্দ করে। কারণ বাকিরা নেসেসারিলি শুধু ভয়ই দেখান। সমব্যথী বোতল নিজেই এগিয়ে এসেছে, কম্পনরত হাত তবু খুলতে পারেনি ছিপি ;এই যে এক ফোঁটা ঘর। বাড়ি জানালা যমুনামায়ের দু’ফোঁটা বালক। এই তো নিরীহ বালিকা দরজা। ভোর হয়ে এলো দুগগাপুজার হুল্লোড়।একটু ঘিয়ে ভাজা মুরগি, একটু ঘিয়ে ভাজা আলু, একটু ঘিয়ে ভাজা অ্যাস্পারাগাস ;গরিবের লাঞ্চ ;ঠিক এইখানেই তোমার বাড়ি। এখানে ঘুম ডাকো তুমি। জাগো প্রাণায়াম থেকে। তারাদের উচ্চারণে কথা বলো। এখানেই নদীটির সিঁথি। সিঁদুরখেলার প্রতিমা।আরো ভাল লাগল, সোজাসাপ্টা বললেন, নিজেদের কেরিয়ার পড়াশুনা নিয়ে থাকতেন, ছেলে নিজের কত পড়াশুনা বা অন্যান্য কাজ করেছে। মায়েরও যে নিজস্ব জগত, আইডেন্টিটি থাকতে পারে, আর সেটা যে রেঁধেবেড়ে সংসারকে খাওয়ানোর বাইরেও অন্য কিছু করার আছে, সেটা এত স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। দু:খ, এসব বোঝাতে হল সেই সাংবাদিককে যিনি আবার কিনা মহিলাই। স্টিরিওটাইপিং, তোমার শেষ যে না পাই!! তো আমি জানি ঘটনা, পাশে থাকার সুবাদে উনার কিন্নর কণ্ঠের বজ্রনিনাদ আমি কী দিনে, কী রাতে শুনি ডেইলি। এই তো গেল ভাবি, ভাইয়ের ভাষা শুনলে আগে ছাদের তালা ভাঙতে মন চায়, তারপর উপ্রেত্থেকে লাফ দিয়া পইড়া মইরা যাইতে মন চায়।

         আর যতীন লিখেছিল এই রচনাটা :

যতই ভাবি, বলি তোমরা সবাই স্বাধীন এখন। ভোগ কর স্বাধীনতা যে যার মত। গুছিয়ে নাও যে যার সংসার । তবুও কেন জানি তা মানতে চায় না কেউ।তবে কি এই পরাধীনতাটুকুতেই শান্তি সবার ! নাই ভাইদের স্নেহ, লেখবার অবসর। শুধু অবনত শ্রাবণ-গারদ; ভাঁড়েদের উল্লাস, মোহরের ঝনঝন।যাউকগা, আজ সন্ধ্যায় মিসেস চ্যাটার্জী কষাইয়া কষাইয়া মাটন রান্না করিবেন বলিয়া মনস্থির করিয়াছেন। কারণ, তাহার ডাক্তারবাবু খুব সম্প্রতি উহাতে নিষেধাজ্ঞা বসাইয়াছেন। বারবার গৃহত্যাগ বারবার ঘরে ফিরে আসা। সারা দুনিয়া জেনে গেছে আমার দ্বারায় প্রেম – ভালোবাসাটা হবেই না ;আমিও হার মেনে নিয়েছি কারণ সত্যি ওটা আমার টপিক নয়।কারণ গুলো এই যে – ন্যাকামি করবে প্রেমিক, যেটা আমার সবচেয়ে অপচ্ছন্দের, ঠাস করে দুমদাম চড়িয়ে দেবো, তারপর ছেলের মা এসে বলবে, তুমি আমার বাবুকে মেরেছো? লে হালুয়া এসব ঝামেলায় আমি নেই বস। ঝোলাগুড়ে চিতইপিঠার নাহাল এ কলিজা খাবি খায়। বলছিলা ঘরের গল্প একখান, বলছিলা জোনাকি সাজানো ঘর। বাবুইয়ের বাসা লাট খায়। কী দিবা, কাকে দিবা, আমি বলতেছি শোনো, নদীপাড়ে শোক জমা হয়। তুমি বলো শোক নয়, পলিমাটি, চর। ঐ চরটুকু দিবা, ঐ পলিটুকু? দেহ দিছি, প্রাণ দিছি, রইয়া গ্যাছে সংসারখান, তুমার বিধায় লাগে আগুনের খাপরা লাহান ; চিকখইর পাইড়া তাই ছুটসি তুমার পাছ পাছ, এ জনমে, তুমি সাঁই, যত দূর লইয়া যাও,… যাই…সারারাত শরীরে কালাজ্বর। মনে হয়েছে কেউ আমাকে বাক্স বন্দি জোঁকের ভিতর আঁটকে রেখেছে। গলা শুকিয়ে গেছল, একঢোঁক জল চেয়েছি জোঁকের কাছে। খুইট্যা টেঙর ; কিছু সত্যি কথা, কিছু ভয়ের কথা, কিছু অপমানের কথা, কিছু গ্লানির কথা বলছি আজ। আমার বিয়ে হয়েছিল মাত্র এক বছর, তারপর ডিভোর্স, আমি ওর সাথে কোনোদিনই শারীরিক হতে পারিনি সে অর্থে, আমি ওকে ঘেন্না করতাম।না তেমন কোনো কারণ নেই ঘেন্না করার, জানেন তো ও খুব ভালো রান্না করতে পারতো, ওর হাতের খাসি মাংসের ঝোল আমার ফেভারিট ছিল।

           সোনার তালের ঘর, রুপোর তালের ঘর আর লোহার তালের ঘরগুলো আলাদা-আলাদা জায়গায় । সোনার বারো জোড়া দম্পতিকে নিয়ে যাওয়া হল সোনার ঘরে । পনেরো কিলোর ফুটবলে সোনার শেকল লাগানো। অমৃতা-যতীনের মুখে  অন্যদের মতন হাসি খেলছিল । 

             “যাক শেকলে বাঁধা ফুটবলগুলো টেনে নিয়ে যেতে সুবিধা হবে।” বলল যতীন ।

           ওদের সবাইকে চেয়ারে বসতে বলা হলো । তারপর পুরুষদের প্রত্যেকের পায়ে পনেরো কিলো করে সোনার নিরেট বলগুলো শেকলসুদ্ধ তালা লাগিয়ে দেয়া হল । মহিলাদের হাতে পনেরো কিলো করে সোনার সলিড বলগুলো শেকলসুদ্ধ তালা দিয়ে দেয়া হল ।

               স্পিকারে শাহেনশাহের ঘোষণা শোনা গেল, “ আপনারা খুশি তো ? তিরিশ কিলো করে সোনা মানে প্রত্যেক দম্পতি পেলেন ষাট কিলো সোনা । আপনারা এবার বাড়ি যেতে পারেন ।”

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস : গলগণ্ডপুরম

প্রথম পর্ব

মনে পড়ছে, বাস কন্ডাক্টর বলেছিল, স্যার, আপনার পাশে যে লোকটা বসেছিল, সে তো নেমে চলে গেল, কিন্তু তার মাথাটা আপনার কাঁধে রয়ে গেছে ।

এই বাসে যারা চেপেছে তারা সবাই ল্যাংটো ; তা নাহলে চাপতে দেয়া হয় না । যাত্রীরা কে কোথায় যাচ্ছে বা ফিরছে বা আসছে তা চালক জানে না । চালকও ল্যাংটো ।

যে লোকটা নেমে গেল সে জানে প্রতারণার বিষয়বস্তু সর্বদাই একটি আকর্ষণীয় বিষয়, আর যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের স্বভাবে যা আছে তা বহাল থাকে আর সমাজ যখন নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় তখন এক বা অন্য আকারে প্রতারকদের বিকাশ লাভের সম্ভাবনা থাকে। এই গলগণ্ডপুরমে প্রতারণার বিখ্যাত নায়ক নায়িকাদের ইতিহাসগুলোকে একত্রিত করা হবে যাতে দেখা যায় যে এই শিল্পটি অনেক রাজ্যপুরমে চর্চা করা হয়েছে। এদিকে গলগণ্ডপুরম নামের রাষ্ট্রপুরমে রূপগুলো– ছদ্মবেশী, ভানকারী, প্রতারক, আর সব ধরণের জোচ্চোর; যারা সম্পদ, পদ, বা অর্জনের জন্য খ্যাতির মুখোশ পরেছে আর যারা নিছক শিল্পের উন্নতির জন্য এটি করেছেন।যেমন একজন লোক কেবল নানা রকমের কাক আঁকে তো আরেকজন আঁকে বউদের নেতিয়ে পড়া মাই ।

গলগণ্ডপুরমের নাগরিকদের সাথে নৈতিকভাবে আচরণ করার কোন চেষ্টা একে আরেকের সঙ্গে করে  না : তবুও রাষ্ট্রপুরমের প্রতারকদের উপর এই যে নথি লেখা হচ্ছে তার জন্ম একটি গবেষণা থেকে, তা এই যে, একদল চোর-চোট্টা যায়, আরেকদল আসে । মসনদে পোঁদ ঠেকলেই হাল আমলের রাষ্ট্রপুরমে কর্ণধাররা জোচ্চর হয়ে যায় । 

কন্ডাক্টারের কথায় গদাধরের হুঁশ ফিরে এলো আর ওর ঘাড়ে বসে থাকা মুণ্ডুটাকে বলল, এই বাঞ্চোৎ, মাথা নামা। কিন্তু কথাগুলো ওর মুখ দিয়ে না বেরিয়ে কাঁধে বসে থাকা মাথাটার মুখ দিয়ে বেরোলো ।

গদাধর মুণ্ডুটাকে কষে একটা ঘুষি মারল আর ওর নিজের নাক ফেটে রক্ত বেরোতে লাগলো । 

কন্ডাক্টার বলল, এই ঘটনা আখছার হচ্ছে । এই কাঁধে মুণ্ডু ফেলে পালিয়ে যাওয়া আর সেই মুণ্ডু আসল মুণ্ডুর জায়গা নেয়া । আসল লোকটা নিজেরই ডুপলিকেট হয়ে যায় । 

বাস চালক বাস থামিয়ে পেছন ফিরে বলল, সেই কারণেই রাষ্ট্রপুরম নিয়ম করে দিয়েছে যে সমস্ত নাগরিককে ল্যাংটো থাকতে হবে । ল্যাংটো থাকলে নাকি প্রতারণা আর দূর্নীতি থাকবে না ।

গদাধরের ঘাড়ের মুণ্ডুটা বলল, ল্যাংটো থাকা আসলে কি? এটা হল কোন কাপড় না থাকার অবস্থা । যে নেমে গেল তার জীবনের যৌন প্রসঙ্গে নাও থাকতে পারে। হয়তো সে নাগা সন্যাসী যার লিঙ্গ অকেজো করে দেয়া হয়েছে যাতে মেয়েমানুষ দেখে কোনো দমকা চাগাড় না দেয় । মানব সভ্যতা এগোনোর ফলে ল্যাংটো থাকার ব্যাপারে আমাদের  দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে থেকেছে কারণ মানুষ একটি লম্পট শ্রেণির প্রাণী । নৃতাত্ত্বিকরা আগেই ফতোয়া দিয়েছেন  যে মানুষ মূলত নগ্ন অবস্থায়, পোশাক ছাড়াই, তাদের প্রাকৃতিক অবস্থা হিসাবে আরামে থাকতো । অ্যাডাম আর ইভ নামে যাদের গপপো শোনানো হয় তারা ল্যাংটো থাকতো ; বইতে তার প্রমাণ আছে । সে বই কিন্তু আমি লিখিনি । কেউ জানে না কার লেখা। 

বাসচালক গাড়ি থামিয়ে রেখেছিল । বলল, গলগণ্ডপুরমের পৌরাণিক যুগ ছিল ল্যাংটো ঋষি, মুনি, সাধু, সন্তে ঠাশা । এই যেমন জৈনদের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর, সমস্ত জাগতিক জিনিসপত্র ত্যাগ করার ব্রত হিসাবে ভিক্ষুদের জন্য সম্পূর্ণ নগ্নতার উপর জোর দিয়েছিলেন। সাকা, ভারতের এক হিন্দু সম্প্রদায়, খাজুরাহো শহরের দেয়ালে থাকা হাজার হাজার সুস্পষ্ট ভাস্কর্যের মাধ্যমে তাদের নগ্নতার ঐতিহ্যকে আধুনিক ভারতে স্হায়ি করে রেখেছে। প্রায় ১০০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি, খাজুরাহোর  মন্দিরগুলো আধুনিক দর্শনার্থীদের কাছে তার মূল্যবোধকে এমন প্রত্যক্ষতার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয় যে কল্পনার জন্য কিছুই বাকি রাখে না। ওই মন্দিরগুলোর সামনে দিকের আর চারপাশে হাজার হাজার মানুষ আর প্রাণীর মূর্তি আনন্দের সাথে নাচছে । রাজা আর সাধারণ মানুষদের আনন্দময় যৌন মিলনে চিত্রিত করা হয়েছে, পুঁতি, চুড়ি আরে সাজসজ্জা ছাড়া একেবারে ল্যাংটো । মানুষকে ল্যাংটো করে দিলে তার শ্রেণিচেতনা লোপ পায় ।

কন্ডাক্টার বলল, হাই তুলে, যারা মনে করেন ভারতীয় নারীরা পোশাকে পশ্চিমাদের নকল করছেন তারা ইতিহাস সম্পর্কে কীই বা জানে ? সব তো ঘুষ দিয়ে মাস্টার হয়েছে ।  প্রাচীন আর মধ্যযুগে ভারতে যারা বেড়াতে আসতো তারা এই ব্যাপারটা  দেখে বোমকে যেতো  যে পুরুষ আর নারী,  উভয়েই তাদের দেহের নীচের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ছাড়া খুব কমই ঢেকে রাখতেন। ধড়ের চারপাশে আলগাভাবে পরা একটা উত্তরিয় ছাড়া পুরুষ আর মহিলা উভয়েই প্রায় খালি স্তনে যেতেন। এছাড়াও, মহিলারা কখনও কখনও তাদের স্তনের চারপাশে শক্তভাবে অন্য কাপড় বেঁধে রাখতেন বটে কিন্তু তাঁরা নিজেদের বডিকে বোরখা দিয়ে ঢাকতেন না।

ড্রাইভার বলল, তখনকার দিনে মেয়েমানুষ দেখলেও বাঁড়া ছিল পুরুষের আজ্ঞাবহ । ওই তো অ্যাডাম নামের লোকটা কতোদিন ইভের সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালো কিন্তু ওর বাঁড়া দাঁড়ায়নি, যদ্দিন ও ল্যাংটো ছিল । 

দ্বিতীয় পর্ব

আমার নাম মিনহাজ আল-সিরাজ জুজজানি, গদাধরের কাঁধের মুণ্ডুটা ওর দিকে তাকিয়ে বলল : তারপর যোগ করল, শুনে থাকবেন আমার নাম । আমিই তো আপনাদের দেশে এসে যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তাদের ইতিহাস লিখেছি, নয়তো আপনারা জানতে পারতেন না । আপনাদের দেশে তো ইতিহাস লেখার চল ছিল না । ইতিহাসের ঘটনাগুলোকে মহাকাব্য বানিয়ে মহাকবিরা মহা গোলমাল বাধিয়ে গেছেন ।

—আমি ঠিক বুঝেছি। তুই-তোকারি করে ফেলেছি বলে মাফ করবেন । একজন লোক আমার কাঁধে মুণ্ডু রেখে সটকে পড়বে, সেটা আমি সহ্য করতে পারিনি । 

— জানেন তো ?  ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কি মুসলমান আক্রমণকারী বখতিয়ার খিলজি নালন্দা মহাবিহার লুঠ আর  ধ্বংস করে। এই ঘটনা ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। শত শত বছর ধরে অবদান রেখে আসা একটা সভ্য, উন্নত জাতি তৈরী ও জ্ঞান উৎপাদনকারী নিরীহ এই প্রতিষ্ঠানটা ১১৯৩ খ্রষ্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী আক্রমন করে ধ্বংস করে ফেলে। তার আক্রমনের বর্বরতা এত ভয়াবহ আকারে ছিল এ সম্পর্কে আমি আমার “তাবাকাতে নাসিরি” বইতে লিখেছি যে “হাজার হাজার হিন্দু, বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আগুনে পুড়িয়ে আর গলা কেটে হত্যা করে সেখানে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করে খিলজী” এরপর আগুন লাগিয়ে দেয় লাইব্রেরীর বিলডিঙে। লাইব্রেরীতে  এত বেশী বই ছিল যে কয়েক মাস সময় লেগেছিল সেই মহা মূল্যবান বই গুলো পুড়ে ছাই ভষ্ম হতে।  খিলজী শুধু নালন্দাকে পুড়িয়ে ছাই করে নি, একই সাথে পুড়িয়ে ছাই করেছে একটি জাতির সভ্যতা, ইতিহাস, প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের অমূল্য বই যা থেকে আপনারা জানতে পারতেন সে যুগের ভারতবর্ষের শিক্ষার অবকাঠামো, তৎকালীন সামাজিক-সাংষ্কৃতিক অবস্থা ও প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে। জাতি হিসাবেও আপনাদের পিছিয়ে দিয়েছে কয়েক হাজার বছর। 

—একদিক থেকে উনি ভালো কাজ করেছিলেন, বলুন । ওনার জন্যই বাংলা ভাগ হতে পারলো, এতো লোক উদ্বাস্তু হয়ে ঘরছাড়া হলো । এই যে ওই পারে গোরু পাচার চলছে, বেচারা নেতারা একটু টাকাকড়ি করে জেলে যাচ্ছে, উনি যদি না আসতেন তো কিছুই হতো না । বেওয়ারিশ গোরু আর বলদগুলোর তবু হিল্লে হচ্ছে ।

—কিন্তু ওনার কারণেই পাকিস্তানিরা কতো কাণ্ড করতে পারলো একাত্তর সালে, ভেবে দেখেছেন ।

—তা ঠিক । কত্তো বাঙালি এই পারে পালিয়ে এসেছিল । সেসব দেখে বিদেশি কবিরা কবিতা লিখেছিল।

—আর মরিচঝাঁপি ? তার জন্য সবাই জ্যোতি বসুকে দায়ি করে । আসল কালপ্রিট তো বখতিয়ার খিলজি । ভেবে দেখুন আপনি । খিলজি না এলে দেশভাগ হতো না । নন-খিলজি বাঙালিরা আপনাদের দিকে পালিয়ে আসতো না । পালিয়ে এসে মরিচঝাঁপিতে বসত গড়ত না ।

–কিন্তু নন-খিলজিদের জ্যোতি বসুই তো বলেছিলেন, ওদের মেরে তাড়াও ।

–জ্যোতিবাবুর দোষ নেই । খিলজি আর নন-খিলজির ভাগাভাগির জন্য দায়ি বখতিয়ার খিলজি । তাই তো আল মাহমুদ নামে একজন কবি বখতিয়ার খিলজির গুণ গেয়ে মহাকাব্য লিখেছেন ।

নিউটাউনের চোট্টাভরম আবাসনের এগারো তলার ফ্ল্যাটে নিজের পনেরো বাই পঁচিশ বেডরুমে আঠারো ডিগ্রিতে এসি চালিয়ে একুশ ইঞ্চি পুরু বিছানায় শুয়ে, পালবালিশ জড়িয়ে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে, স্বপ্নের মধ্যে বাসের ঘটনাগুলো দেখছিল গদাধর, দুজন প্রেমিকার লাৎ খাওয়া গদাধর, যাদের একজন ওর সমবয়সী অন্যজন বয়সে পাঁচ বছর বড়ো ছিল, স্বপ্নের মধ্যে দেখা দিল আরেকটা ঘটনা, বাসটা অন্ধকারে উধাও, সেই ঘটনা ঘটেছিল বিখ্যাত সঙ্গমতীর্থ সোনাগাছির লাল-নীল-সবুজ টুনি বালব ঝলমলে সন্ধ্যায় আগ্রা রাজস্থানী গার্লস আর উত্তর ভারতীয় দিল্লিটাইপ যুবতীদের জমঘট বাজার নীলকমল, প্রেমকমল, গঙ্গাযমুনা, রাত্রিপ্রেমিক, স্বপ্নেরঘর ঢুঁ মেরে, এক ব্যাটা লাল টিশার্ট আর চোঙা ফেডেদ জিন্সপরা পিম্পের সঙ্গে দেখেছিল ঘুরে-ঘুরে ;  সে নিয়ে গিয়েছিল সস্তার  বাঙালি সুন্দরীদের বাড়িউলি নন্দ রানীর আড্ডাতেয় । পিম্পটা জ্ঞান দিয়েছিল, যেন পাহাড়ের ওপর থেকে কোনো ধর্মপুরুষের বাণী, ডলবি ডিজিটালে, যে এই এলাকাটা চালায় পিম্প, পুলিশ, পলিটিশিয়ান আর পয়সা ; এই চারটে পি সেবা করে আরেকটা পি যাকে লোকে বলে পেনিস। গদাধর বলল, আরে মিস্টার, আসল পি তো বাদ দিলে, প্রস্টিটিউট । 

–চুপ, চুপ, স্যার, ওই শব্দটা মুখ থেকে বের করবেন না । 

গদাধর বেছে নিয়েছিল সবচেয়ে সুন্দরী আর দামি নন্দিনী কৌর নামের এক দিল্লিওয়ালিকে, যে, কাজ শুরু হবার আগেই, বেঁজি যেমন কেউটের ছোবল এড়াবার জন্যে স্প্রিঙের মতন লাফিয়ে পেছনে সরে গিয়ে ফিরে আক্রমণ করে , বলে উঠেছিল, আবে, তু সালে মুসলমান হ্যায়, বাংলাদেশি ভগোড়া ? 

—না গো চুলবুলেশ্বরী, আমার জন্মের পর পেচ্ছাপ বেরোচ্ছিল না, খোসার মুখটা বন্ধ ছিল, পেট ফুলে যাচ্ছিল, তাই পেডিয়াট্রিক সার্জেন ফোরস্কিন বাদ দিয়ে  রিমুভ করা জায়গায় পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে তা গজ দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন । আমার বাপকে তার জন্য দশ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছিল, যা তুমি নিচ্ছ আজকে রাতটা তোমার সঙ্গে শোবার জন্য ।  তুমি যেমন দিল্লি থেকে এসে এই শহরে ব্যবসা ফেঁদেছ আমার গ্র্যাণ্ডফাদার বিদ্যাধর সেন কৃষ্ণনগর থেকে এই শহরে এসে ব্যবসা ফেঁদেছিল, কাপড়ের, সেই ব্যবসাই চালায় আমার বাপ আর আমার দাদা ।

—-আমি মুসলমান কাস্টমার নিই না, আমার এজেন্টকে বলা আছে । 

—-মুসলমানরা ওটা শুরু করেনি চুলবুলিদেবী, ওটা অনেক আগের, ইহুদিদের জেনেসিস বইতে লেখা আছে,  ইয়াহওয়েহ আব্রাহামকে বললেন, এবার থেকে তুমি  আমার চুক্তি পালন করবে, তুমি আর তোমার পরে তোমার বংশধরেরা আর  বংশ পরম্পরায় মানতে হবে এই চুক্তি। তোমাদের প্রত্যেক পুরুষকে সুন্নত করা হবে। তোমাদের নুনুর ডগার  মাংসে সুন্নত করানো হবে, আর এটা আমার আর তোমাদের মধ্যে  মাংসল চুক্তি ৷ তোমাদের মধ্যে যার বয়স আট দিন হবে তার সুন্নত করা হবে৷ তোমাদের বংশ পরম্পরায় প্রত্যেক পুরুষ, তা তোমাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করুক বা কেনা গোলাম হোক৷ তোমার কোঁচড়ে আমার চুক্তি হবে চিরস্থায়ী চুক্তি। যে কোন খৎনা না করা পুরুষকে  তার লোকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে; কেননা  সে আমার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। 

–জানি, সব মানুষ কোনো না কোনো বই থেকে জন্মেছে । ওই তুমি যে বললে, ইহুদিরা একটা বই থেকে জন্মেছে। 

—আরও অনেক দেশের লোকেরা করে । আসলে যে দেশে বালির ঝড় হয় সেখানকার পুরুষদের চামড়ার ভেতরে বালুকণা ঢুকে কষ্ট দিতো, ঘা হয়ে যেতো, তাই খোসা ছাড়াবার প্রথা । যারা ইহুদিদের বইটাকে মেনে নিজেদের বই থেকে জন্মায়, তারাও মেনে নিয়েছে । জলের অভাব বলে ধোয়াধুয়ি ওদের শুচিব্যামো। হিসি করার পর ধোয়, ঈশ্বরের বাড়িতে যাবার আগে ধোয়, মরবার পর কবরে যাবার আগে ধোয় ।

— কিন্তু ভক্ত কবীর দাস বারণ করে গেছেন আর তা গুরুগ্রন্হে লেখা আছে । 

—তাই বুঝি ? জানতুম না । তবে এটা জানি, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিজয়ের পরে,  খতনাকে গ্রীকরা অপছন্দ করতো । ওরা মনে করতো খতনার ফলে পুরুষ অসম্পূর্ণ হয়ে যায় । এর ফলে গ্রিকদের  মধ্যে এর প্রবণতা হ্রাস পায় আর গ্রিক জিমনাশিয়ামে সবাইকে ল্যাংটো হয়ে ব্যায়াম করতে হতো বলে কেউ আর নুনুর খোসা ছাড়াবার প্রথা অনুসরণ করতে চাইতো না । গ্রিক জিমনাশিয়ামে  ল্যাংটো থাকাই ছিল আদর্শ। ভ্যাটিকান সিটির বাইরে অ্যাপোলোর একটা ল্যাংটো মূর্তি আছে, খোসাসুদ্ধ, কিন্তু বড্ডো ছোটো । গ্রিক আর রোমানরা বড়ো মাপের নুনু শুধু অসুর-দানবদের মূর্তিতে দিতো । দেবতাদের বেলায় ছোট্টো, খোকাদের মতন ।

—তুমি তো তাহলে অসুর বা দানব । আচ্ছা, তুমি যে কাজের জন্যে এসেছো তা শুরু করছ না কেন। তখন থেকে আমার শরীরে নানা জায়গায় গুপ্তধন খুঁজে বেড়াচ্ছ আর গল্প শুনিয়ে নিজের শরীর-মনকে উত্তেজনার বাইরে রেখেছ ?

—আমার এই খোসা ছাড়ানো ব্যাপারটার কারণে ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ আমাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাঠিয়েছিল । আমি ন্যাশানাল ক্যাডেট কোরে ছিলুম আর রাইফেল, পিস্তল চালাতে ভালো লাগতো। একেবারে অব্যার্থ হয়ে গিয়েছিল আমার টিপ । সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে গিয়েছিলুম, ছাতির মাপ সেসময়ে কম ছিল বলে নেয়নি । ওদের কাছে আমার রেকর্ড ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের কচুকাটা করার জন্যে তৈরি হচ্ছে জানতে পেরে আমাদের দেশেও রেডি হবার তোড়জোড় আরম্ভ হয়ে যায় । 

গদাধর আবার পুরোনো স্বপ্নের দ্বিতীয় পর্বে ফিরে গেল, অন্ধকার বাসযাত্রায় । গদাধর পেছন ফিরে দেখলো বেশ কয়েকজন তরুণীর দেহটা মেয়ে মানুষের আর তার কাঁধে একজন পুরুষ মাথা রেখে পালিয়েছে । এই ডুপলিকেটটা আমার কাঁধে মাথা না রাখলে আমি পেছনে গিয়ে কোনো যুবতীর কাঁধে মাথা রাখতুম ।

ড্রাইভার বাস চালানো আরম্ভ করে দিয়েছিল । বলল, সব মানুষ কোনও না কোনও বই থেকে জন্মেছে । আপনি ঘাবড়াবেন না, আপনার কাঁধ থেকে মাথাটা সটকে পড়লেই কোনো যুবতীর কাঁধে মাথা রাখবেন, বাসে রাখুন বা রাস্তায় হাঁটার সময়ে রাখুন । আমরা সবাই কোনো না কোনো বই থেকে জন্মেছি । অ্যাডাম আর ইভ জন্মেছিল জেনেসিস বা আদিপুস্তক থেকে। 

বইয়ের ঈশ্বর বললেন, ঘ্যাচাঙ ফুঃ, এখন এসো, আমরা মানুষ সৃষ্টি করি। আমার আদলে আমরা মানুষ সৃষ্টি করব। মানুষ হবে ঠিক আমার মতন। তারা সমুদ্রের সমস্ত মাছের ওপরে আর আকাশের সমস্ত পাখির ওপরে কর্তৃত্ত্ব করবে। তারা পৃথিবীর সমস্ত বড় জানোয়ার আর বুকে হাঁটা সমস্ত ছোট প্রাণীর ওপরে কর্তৃত্ত্ব করবে।” ঈশ্বর মাটি থেকে ধুলো তুলে নিয়ে একজন মানুষ তৈরি করলেন এবং সেই মানুষের নাকে ফুঁ দিয়ে প্রাণবাযু প্রবেশ করালেন আর মানুষটা জীবন্ত হয়ে উঠল। ঈশ্বর সেই মানুষটাকে  গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করলেন। মানুষটা যখন ঘুমোচ্ছিল তখন  ঈশ্বর তার পাঁজরের একটা হাড় বের করে নিলেন।  ঈশ্বর মানুষটার পাঁজরের সেই হাড় দিয়ে তৈরি করলেন একজন নারী । নারীকে ঈশ্বর মানুষটার সামনে নিয়ে এলেন।  মানুষটা বলল,“যাক অ্যাদ্দিনে আমার মতন একজনকে পেলুম । আমার পাঁজরা থেকে তার হাড়, আর আমার শরীর থেকে তার দেহ তৈরী হয়েছে।  নর থেকে তার সৃষ্টি হয়েছে বলে তাকে ‘নারী’ বলে  পরিচয় দেয়া হবে।” সেসময়ে নরনারী ল্যাংটো থাকতো, কিন্তু সেজন্যে তাদের কোন লজ্জাবোধ ছিল না।পরের বইটার নাম নিউ টেস্টামেন্ট । সেই বই থেকে আরেকদল মানুষ জন্মেছে । ঈশ্বর তাঁর পবিত্র, নির্দোষ এবং প্রেমময় লোক হবার জন্য আমাদের খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে বেছে নিলেন।ঈশ্বর  যাকে ভালবাসেন সেই খ্রীষ্টের মাধ্যমেই  ঈশ্বর নতুন বই থেকে খ্রিস্টান সৃষ্টি করলেন । 

বাসচালক স্টিয়ারিঙ ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, আমরা কিন্তু বাঙালি, আমরা একটা বই থেকে জন্মাইনি, অনেকগুলো বই থেকে জন্মেছি, তা লোকে নিজেকে বাঙালি বলে মানুক বা না মানুক ।

পেছনের কোনো সিটে পুরুষের কাঁধে মাথা রেখে যে নারীদেহ পালিয়েছে, সেই নারীমুখ বলল, আমি এই বিষয়ে পিএইচডি করেছি ।  বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে হরিবংশে যে কাহিনি আছে, সেই কাহিনি থেকে আমরা জানতে পারি যে পুরু  বংশে বলি নামে এক রাজা ছিলেন। সেই রাজার পাঁচ ছেলে ছিল, তাদের নাম  অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুহ্ম ও পুশু। মহাভারতের আদিপর্বেও অসুর-রাজ বলির এই পাঁচ ছেলের উল্লেখ আছে। বলিরাজার এই পাঁচ ছেলে যে পাঁচটা রাজ্য শাসন করতে, তাদের নাম থেকেই এই পাঁচটি রাজ্যের নামকরণ হয়েছিল। বলিরাজার এই পাঁচটি ছেলে বালেয় ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত, এবং তাঁরাই চারি বর্ণের সৃস্টি করেছেন। মৎস্য আর বায়ু পুরাণেও বলা হয়েছে যে, বলিরাজার ছেলেরাই জগতে চারি বর্ণের সৃষ্টি করেছেন। ‘মুঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ নামের একটা বইতে বলা হয়েছে যে, বাঙলাদেশের  লোকেরা ‘অসুর’ জাতিভুক্ত। এটা মহাভারতের এক উক্তি থেকেও সমর্থিত । সেখানে বলা হয়েছে যে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড ও সুহ্মদেশের লোকেরা দীর্ঘতমা ঋষির ঔরসে, মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভে অসুর-রাজ বলির ক্ষেত্রজ সন্তান। 

বাস কন্ডক্টর জিগ্যেস করল, আমরা অসুর ?  তাই বলি । এতো এতো টাকা নিয়ে মুকখুগুলোকে টিচার করেছে, তা অসুররা ছাড়া কেই বা করবে । কত্তো টাকা ! বাপরে বাপ । তার ওপর আবার স্যাঙাৎসুন্দুরীর দল । চোখ জুড়িয়ে যায় ।

পেছনের কোনো সিট থেকে যুবকের কাঁধে মাথা রেখে পালানো যুবতীর কন্ঠে কেউ বলল, এখন কথা হচ্ছে এই অসুর জাতির লোকেরা কারা, এবং তারা কোথা থেকেই বা বাঙলাদেশে এসেছিল। বৈদিক ও বেদোত্তর সংস্কৃত সাহিত্যে ‘অসুর’ শব্দটির খুব ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় দেবগণের বিরোধী হিসাবে। ঋগ্বেদে শব্দটির বহু উল্লেখ আছে। ঋগ্বেদের বিভিন্ন মণ্ডলের যে সকল সূক্ত ও ঋকে ‘অসুর’ শব্দটির উল্লেখ আছে সেগুলো যথাক্রমে ১।২৪।১৪, ১৫৪।৩, ২।১।৬, ৩।৩।৪, ৪।২।৫, ৫।১২।১, ৬।২২।২, ৭।২।৩, ৭। ৬।২, ৭।৬।২, ৭।১৩।১, ৭।১৩।১, ৭।৩০।৩, ৭।৩৬ ২, ৭।৫৬।২৪, ৭।৬৫।২৪, ৬০।৬৫।২, ৭।৯৯।৫, ৮।৯।২৩, ৯।৭৩।১ ও ১০/১০/২। সিন্ধুর অসুর-রাজ ও অন্যান্য অসুর-রাজগণের উল্লেখও ঋগ্বেদে আছে। আমরা অনুমান করেছি যে, অসুররা বিস্তৃত-শিরস্ক জাতি ছিল। প্রথম অধ্যায়ে আমরা প্রাচীন নরকঙ্কাল সম্বন্ধে যে আলোচনা করেছি তা থেকেও, জানতে পারি যে, হরপ্পা যুগে গুজরাট ও সিন্ধুপ্রদেশে বিস্তৃত- শিরস্ক জাতি বিদ্যমান ছিল। ভারতের মেগালিথ নির্মাণকারীরাও বিস্তৃত- শিরস্ক জাতি ছিল। মেগালিথে অনুরূপ প্রোথিত শিরাখণ্ড বাঙলার মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলায় পাওয়া গিয়েছে।

গদাধরের কাঁধে মাথা রাখা মিনহাজ বলল, অনেকে মনে করেন যে ‘অসুর’ বলতে আর্যপূর্ব-যুগের ভারতের এক দেশজ জাতি বুঝাত। যদি অসুররা বৈদিক আর্যগণের আগমনের পূর্বেই ভারতে এসে থাকে, তা হলে তারা যে দেশজ এই মতবাদ গ্রহণ করতে কোনো আপত্তি নেই। বৈদিক সাহিত্যে আমরা ‘দাস’, ‘দস্যু’, ‘নিষাদ’ প্রভৃতি আরও অনেক দেশজ জাতির নাম পাই। সুতরাং বৈদিক আর্যগণের ভারতে আগমনের পূর্বে এদেশে যে একাধিক জাতি বাস করত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এদের অনেককেই অনার্য-ভাষাভাষী বলা হয়েছে। 

গদাধর চটে গিয়ে মুণ্ডুটাকে ঘুষি মারতেই সেটা গদাধরের নাকে লেগে নাকমুখ থেকে রক্ত বেরোতে লাগল । রক্তাক্ত মুখেই গদাধর বলল, শালা, আর্য-অনার্য থিয়োরি চাপিয়ে গেছে ইংরেজগুলো, তাই নিয়ে লোকে এখনও কপচে চলেছে । আর্য এবং অনার্য তত্ত্ব হলো ১৮ শতকের মিথ্যা ইউরোপীয় প্রচার তত্ত্ব যা ১৮ শতকে ব্রিটিশ-রা তৈরি করেছিল ভারতীয় মানুষদের ছোট দেখানোর জন্য এবং তাদের ইউরোপীয়ান মানুষদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য। আর্য এবং অনার্য তত্ত্ব সম্পুর্ন একটা মিথ্যা এবং ভুল ধারণা, আর্য এবং অনার্য তত্ত্ব কথা থেকে এসেছে? ব্রিটিশ-রা প্রথম যখন ভারতবর্ষে আসল তখন তারা ভারতবর্ষের মধ্যে থাকা অসীম গৌরব এবং বৈভব দেখে তাদের মনে হিংসা জাগে, তখন তারা ভারতবর্ষের সকল জিনিসের কৃতিত্ব তাদের নিজের নামে করার জন্য একটা ফন্দি আঁটে, এবং এই ফন্দিটার নামই হচ্ছে, “আর্য অনার্য তত্ত্ব” আর্য অনার্য তত্ত্বের মুল ভিত্তি হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ বছর আগে নাকি একদল ইউরোপীয়ান মানুষ ইউরোপ থেকে এসে ভারতবর্ষে আক্রমণ করে , এবং তারা স্থানীয় ভারতীয় মানুষদের নাকি পিছনে তাড়িয়ে দেয়, তারা নাকি ঘোড়া এবং রথে চড়ে ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিল, এবং তারা নাকি সঙ্গে করে বেদ নিয়ে এসেছিল এগুলো সিব মিথ্যা এবং ভুল তথ্য ব্রিটিশদের দ্যারা ভারতীয় মানুষদের ছোট দেখানোর জন্য ১৮০০ শতকে তৈরি করা হয়েছিল।এবং বিড়ম্বনা হলো, ১৮০০ শতকের পুরনো ব্রিটিশদের তৈরি মিথ্যা তথ্য গুলো আজও ভারতবর্ষের বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে বাচ্চাদের পড়ানো হয়,

প্রচলিত ধারণায়, ‘ইন্দো-ইউরোপীয়’ ভাষাভাষীদেরই আর্য বলা হয়ে থাকে। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, দীর্ঘকায়, গৌডরবর্ণ এবং দেখতে সুদর্শন আর্যরা ছিল ভারতের বহিরাগত এক জাতি — যাদের আদি বাসস্থান ছিল মধ্য-এশিয়া অথবা রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল অর্থ কিংবা ইউরোপের অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী অথবা চেকোশ্লোভাকিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। ঋকবেদের রচনাকালের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকরা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দকেই ভারতে আর্যদের সম্ভাব্য আগমনকাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রথম দিকে আর্যরা আক্রমণকারী হিসেবে ভারতে প্রবেশ করেনি; শান্তিপূর্ণভাবেই নিজেদের গৃহপালিত পশু, জীবনযাত্রার উপকরণ ও দেবদেবী সঙ্গে নিয়ে তারা ভারতে আসে, কিন্তু পাঞ্জাবে বসতি স্থাপন করার পর থেকে ক্রমেই আর্যরা আক্রমণকারীর রূপ ধারণ করতে থাকে। ঋকবেদের যুগের প্রথম পর্যায়ে, ১৫০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, আফগানিস্তানের সীমান্ত থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভারত-ভূখণ্ডে আর্যরা বসতি স্থাপন করলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে আর্যরা ভারতের আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে গঙ্গা ও যমুনা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে। পরবর্তী বৈদিক যুগ অর্থাৎ ‘ব্রাক্ষ্মণ’ রচনার যুগে সরস্বতী নদী থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের কোশল (অযোধ্যা), কাশী, বিদেহ মানে উত্তর বিহার, মগধ মানে দক্ষিণ বিহার, অঙ্গ মানে পূর্ব বিহার অঞ্চলে আর্য-সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল। দক্ষিণ ভারত ও বাংলায় আর্য-সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল অনেক দেরিতে।

—বুঝলেন তো আপনারা ! বলল বাসচালক, অন্ধকারে গাড়ি থামিয়ে । তারপর যোগ করল, আমরা যে বইটা থেকে জন্মেছি তার নাম ঋগ্বেদ । ঋগ্বেদে বিশ্বজগত সৃষ্টি সম্পর্কে বহু তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে। ঋগ্বেদের পুরুষসূক্ত অনুযায়ী, সৃষ্টির প্রকাশ হয়েছিল হিরণ্যগর্ভ নামক এক মহাজাগতিক অণ্ড তথা ডিম থেকে যার মাঝে সমস্ত কিছু সুপ্ত অবস্থায় ছিল। এ সূক্তে বর্ণনা করা হয়েছে, পুরুষের বিরাট নামক বিশ্বরূপ হল সৃষ্টির উৎস। বিরাটের মধ্যে সর্বব্যাপী জ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে এবং বিরাট থেকে বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। শেষের দিকের মন্ত্রগুলোতে বলা হয়েছে, পুরুষ নিজেকে আহুতি দিয়ে পক্ষী, বন্য ও গবাদি পশু, চার বেদ, মন্ত্রের ছন্দ সৃষ্টি করেন। তার মুখ, বাহু, জঙ্ঘা ও পা থেকে চার বর্ণের জন্ম হয়। পুরুষের মন থেকে চন্দ্র ও চোখ থেকে সূর্যের জন্ম হয়। তার মুখ ও নিঃশ্বাস থেকে ইন্দ্র ও অগ্নির জন্ম হয়। তার নাভি থেকে আকাশ, মাথা থেকে স্বর্গ, পা থেকে পৃথিবী ও কান থেকে অন্তরীক্ষের জন্ম হয়।এই সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষ, জাগতিক ও মহাজাগতিক সকল সত্ত্বার মধ্যে একত্ব স্থাপিত হয়। কারণ, সবই সেই একক সত্ত্বা পুরুষের অংশসম্ভূত। পুরুষসূক্তে আরো বলা হয়েছে, পুরুষের কৃত যজ্ঞের মাধ্যমে এবং যজ্ঞ থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। এই আদি যজ্ঞ থেকেই যাবতীয় সৃষ্টি রূপ ধারণ করেছে। সপ্তদশ মন্ত্রে বলা হয়েছে যে, এই আদি যজ্ঞ থেকেই যজ্ঞের ধারণার উৎপত্তি হয়েছে। শেষ মন্ত্রগুলোতে সকল সৃষ্টির আদিশক্তি রূপে যজ্ঞের গৌরব ঘোষিত হয়েছে। নাসদীয় সূক্তও বিশ্বতত্ত্ব ও ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তির ধারণার সঙ্গে জড়িত। বিশ্বসৃষ্টির বিষয়ে সূক্তটি ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দার্শনিক মহলে প্রসিদ্ধ। ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তে সৃষ্টিতত্ত্ব সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিভিন্ন পুরাণেও বিশ্বজগৎ ও মানব সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনার পাশাপাশি অসংখ্য মহাবিশ্বের ধারণা উল্লেখ করা হয়েছে।এছাড়াও শতপথ ব্রাহ্মণে, মনুসংহিতায়, ঐতয়ের উপনিষদে, সাংখ্য-দর্শনেও বিশ্বজগৎ ও মানব সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে।

কন্ডাক্টার বলল, আরেকদল মানুষ যে বইটা থেকে জন্মেছে তার নাম আবেস্তা বা জেন্দ আবেস্তা হল জরাথুস্ট্রবাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এটি আবেস্তা ভাষায় রচিত। আবেস্তাকে ফারসি ও ইংরেজি সহ অন্যান্য ভাষায়ও অনুবাদ করা হয়েছে। এর প্রাচীনতম অংশ হল গাঁথাসমূহ, যেগুলো স্বয়ং জরাথ্রুস্ট্র দ্বারা রচিত ধর্মীয় স্তবজ্ঞান। জরাথুস্ট্রবাদে আরও দুটি ধর্মীয় গ্রন্থ রয়েছে যার নাম দেওয়া হয়েছে দেনকার্দ এবং আরদাভিরাফ নমক। আবেস্তা বা জেন্দ আবেস্তা নামটি দ্বারা ধর্মীয় ভাষা এবং ধর্মীয় গ্রন্থ উভয়কেই বোঝায়। জারথুস্ট্র ধর্মের বিশাল সাহিত্য (পারস্য/ইরানে আরব মুসলিমদের বিজয়ের আগে মূল ধর্ম) যে ভাষার আশ্রয় নিয়ে তৈরি হয়েছিল, তাকে ‘আবেস্তা’ বা ‘আভস্তাই ভাষা’ বলা হয়। উক্ত সাহিত্যে নবী জরাথুস্ট্র বা তাঁর সমসাময়িক অনুসারীদের ভাষার নাম কি ছিল বা কথ্য ভাষা কি ছিল তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তবে ঐতিহ্য অনুসারে প্রমাণিত হয় যে সেই ভাষা ও সাহিত্যের নামটিও ছিল “অবিস্তক”। অনুমান করা হয় যে “বিদ” ,জানা, এই শব্দের মূলধাতু, যার অর্থ ‘জ্ঞান’ বা ‘প্রজ্ঞা’।

দিল্লিওয়ালি চুলবুলেশ্বরী সুযোগ বুঝে গদাধরের স্বপ্নে ঢুকে পড়েছিল, উলঙ্গ, তাই কেউ টের পায়নি । গদাধরের কাঁধ থেকে পুরুষের ফেলে যাওয়া মাথাটা দুহাত দিয়ে উপড়ে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দেবার পর গধাধরের পাশে বসে বলল, তুই সত্যিই অসুর, অনার্য, আর আমি আর্য, দ্যাখ আমার কাঁচা সোনার মতন গায়ের রঙ আর তোর কালচে গায়ের রঙ ।  তুই যা বলিসনি, তা হলো, যারা পড়াশুনা করেছে তারা জন্মেছে চার্লস ডারউইনের বই থেকে । ডারউইন ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত তাঁর অন দ্যা অরিজিন অব স্পিসিজ গ্রন্থে তাঁর প্রমাণ ও সিদ্ধান্ত আরও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছিলেন। ১৮৬১ সালে প্রকাশিত বইটির তৃতীয় সংস্করণে ডারউইন স্বীকার করেছিলেন যে উইলিয়াম চার্লস ওয়েলস ১৮১৩ সালে এবং প্যাট্রিক ম্যাথিউ ১৮৩১ সালে একইরকম মত প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা কেউই সেগুলোকে বিস্তৃত করেননি কিংবা কোন খ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় উপস্থাপন করেননি।

গদাধর বাসের বাঁদিকের সারিতে প্রথম সিটে বসেছিল, কাঁধে অন্য লোকের মাথা থাকায় দেখতে পেলো না মেয়েটিকে, যদিও তার কন্ঠস্বর শুনে গদাধর আঁচ করতে পারছিল মেয়েটির কাঁধের বদলে বুকে মাথা রেখে বডি ফেলে পালিয়েছে দুজন লোক । 

মেয়েটি বলছিল,  কর্মক্ষেত্রে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বলি । বাংলায় সবচেয়ে ঢপবাজ পত্রিকায় এক কমবয়সী মেয়ের যোগ দেওয়া, সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার একরাশ স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করা, সিনিয়রদের অন্ধের মতো বিশ্বাস করা হয়ে দাঁড়াল ভয়ঙ্কর। একজন আদ্দামড়া সিনিয়ার পুরুষ সহকর্মীর অভব্য আচরণ, যৌন হেনস্থা, যা থেকে বাঁচতে আমাকে বাধ্য হয় অভিযোগ জানাতে হয়েছিল। আমি সদ্য বিবাহিতা, সবে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করেছি । ঢপবাজ পত্রিকার জেলা ডেস্কে কাজ করার সেই সময় আমার সঙ্গে এই নোংরামি করেছিল লোকটা । ঢপবাজ পত্রিকার জেলা ডেস্কেই আমাকে যৌন হেনস্হা করা শুরু হয় । জেলা ডেস্কের তখনকার চিফ মিস্টার গাধাবাহন বর্মণ নানা অছিলায় আমার কাঁধে, গায়ে হাত দিতো, আমার স্যানিটারি প্যাড, পোশাক, অন্তর্বাস, যৌন জীবন নিয়ে আলোচনা করতে চাইতো । শেষ পর্যন্ত এই অভিযোগ গিয়ে পৌঁছোয় বাঁজারাম শিকদারের চেম্বারে, যা প্রতিপন্ন হয় চূড়ান্ত এক সামন্ততান্ত্রিক, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আঁতুড়ঘরে।

ড্রাইভার : আরে ! হাইহিল জুতো পায়ে পোঁদে একটা লাৎ কষাতে পারতে তো ?

মেয়েটি বলা বজায় রাখলো । একদিন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে, আমি জেলা ডেস্কের প্রধানের বিরুদ্ধে এই লাগাতার যৌন হেনস্থা আর নোংরা আচরণ নিয়ে অভিযোগ জানাই পত্রিকার বার্তা সম্পাদক চামচাচরণকে । উনি পরামর্শ দেন, গাধাবাহন বর্মণের বিরুদ্ধে অফিসের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেলে অভিযোগ জানাতে। যদিও তিনি ভালোই জানতেন, এই সেলের মাথায় রয়েছেন সংস্থার এইচ আর ডিপার্টমেন্টের প্রধান চিকনি চামেলি, যাঁর সঙ্গে অভিযুক্ত গাধাবাহন বর্মণের মাখামাখি সম্পর্ক। অভিযোগ জানানোর পরই আমি বুঝতে পারি যে এই ঢপবাজ পত্রিকার দাবার ছকে আমাকে বোড়ের মতন খেলাচ্ছে পুরুষের দল । সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেলের কিছু লোক দেখানো মিটিং হয়, কিন্তু পরিস্থিতি বদলায় না। বরং আমার কাছে অফিসের পরিস্থিতি আরও অসহনীয় হয়ে ওঠে।

এরপর একদিন হঠাৎই মালিক বাঁজারাম শিকদারের  ঘর থেকে ডাক আসে । সাংবাদিকের। সেটিই ওই ঢপবাজবাবুর সঙ্গে আমারর প্রথম আর অবশ্যই শেষ সাক্ষাত। 

ঢপবাজবাবুঃ  আমি শুনেছি, তোমার কাছে এই অভিযোগের কোনও প্রমাণ নেই।

আমি : স্যর, যৌন হেনস্থার কী প্রমাণ থাকতে পারে?

ঢপবাজবাবুঃ (সামান্য হেসে), তবে তুমি কীভাবে এই অভিযোগের বিচার বা সমাধান পাবে আশা করতে পারো?

আমি : (বিস্ময় এবং কান্না চেপে), তবে এই সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেল কেন রয়েছে স্যর?

ঢপবাজবাবুঃ কারণ, এটা এখনকার দিনে কর্পোরেট বাধ্যবাধকতা। ঠিক যেভাবে আমাদের দেশে ইউজলেস বিচার ব্যবস্থা আছে, সেরকম। আমাদের আইন আছে, আইনজীবী আছে, বিচারক আছে, কিন্তু কতজন মানুষ বিচার পায়? কর্পোরেট সংস্থায় সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেলও অনেকটা তাই। আজকের কর্পোরেট দুনিয়ার এটাই নিয়ম, তাই এই সেল করা হয়েছে, মাই ডিয়ার। যদি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে মারপিট হয়, বাবা তোমাকে চড় মারে, তুমি কি থানায় যাও অভিযোগ জানাতে? নিজেদের মধ্যে ঝামেলা তো মিটিয়ে নাও। তবে এখানে অভিযোগ জানাতে গেলে কেন? এটা কি তোমার পরিবার নয়? অভিযোগ তুলে নাও। এবং তাড়াতাড়ি। লিখে দাও, ভুল বোঝাবুঝি একটা হয়ে গিয়েছিল এবং তুমি তা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাও না। চাইলে আমি তোমাকে অন্য ডিপার্টমেন্টে বদলি করতে পারি।

আমি আর কথা বাড়াইনি । সিটে ফিরে পদত্যাগপত্র টাইপ করে ঢপবাজবাবুর মুখে ছুঁড়ে মেরে চলে এসেছি ।

বাসের সব যাত্রীরা একসঙ্গে চিৎকার করে বলতে থাকে, বাস ঘোরাও, বাস ঘোরাও, চলো ওই ব্যাটা ঢপবাজকে ধরে আমরা সবাই মিলে প্যাঁদাবো ।

বাসচালক বলল, ঘোরানো যাবে না, কেননা ওই ঢপবাজ হলো একটা গল্প বলার সংস্হা । গল্প যখন আখ্যানের কারাগার থেকে মুক্তি পায়, আমরা টের পাই গল্পের জটিলতা আসলে বিস্ময়কর। ন্যারেটিভিস্টরা গল্পকে রৈখিক-প্লট সহ একটি কালানুক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেন, শুরু, মধ্য এবং শেষের সাথে একটি সমন্বিত কথকতা। যদি আমরা আখ্যানের কারাগার থেকে গল্পকে মুক্ত করি, তবে, বিশেষত পুঁজিবাদী বিশ্বের সংস্থাগুলিতে, জটিল গল্প বলার বিক্রয়যোগ্য পদ্ধতি খুঁজে পাই,  যাকে বলা যায় “গল্প বলার সংস্থা” ।   গল্প বলার সংস্থাগুলো গল্পগুলোকে  পাবলিকের মাথায় লেলিয়ে দিয়েছে । গল্প সাপ্লাই কোম্পানির অবদান হল গল্পের একটা তত্ত্ব যা কৌশল, নেতৃত্ব আর সংস্থাগুলোর ভার কমিয়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য আখ্যানের জটিলতা এড়িয়ে   কাজ করে। এখনকার অধিকাংশ ঔপন্যাসিক, যাঁরা বাজার ধরতে চান, তাঁরা নানা কোম্পানিরা যে কাজ করছে সেই কাজই তাঁদের পাল্প ফিকশানে করেন।”

তৃতীয় পর্ব

বাসের উড়ন্ত যাত্রাপথ ছিল সস্তা নেশা, হুইস্কি-হেডস, হোঁচট খাওয়া,  মাস্তানদের পাড়া; বেশ্যাদের  লাইন, গরিব সৎ শ্রমিকদের হাইতোলার পরিসর আর অপরাধের  প্রজনন ক্ষেত্র। উদাস চোখের বেশ্যারা রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে অশ্লীলতা অদলবদল করছে  নোংরাদের সাথে। ছিনতাইকারী আর চোর অন্ধকারের খোঁজে বেরিয়েছে । ডাকাতি করার জন্য অপেক্ষা করছে ছোকরার দল। একে অপরকে ছাড়া এরা কেউ টেকে না। 

গদাধরের মনে পড়ল, গত বছর শরতের এক নিস্তেজ, অন্ধকার আর ঘড়ঘড়ে শব্দহীন দিনে, যখন মেঘ আকাশে নিপীড়নমূলকভাবে ঝুলছিল, তখন আমি দূরপাল্লার এক লজঝড় সরকারি বাসে । দেশের একক নিরানন্দ মাঠ-ময়দানের মধ্য দিয়ে বেঘোরে ছুটছিল বাসটা, কখনও নীল রঙের পোঁচ ; সন্ধ্যার ছায়া ঘনিয়ে আসার সাথে বুঝতে পারলুম পাশের লোকটা আমার কাঁধে মাথা রেখে নাক ডাকছে ।  বিষণ্ণ ধানখেতের দৃশ্য মাখতে চাইছিল না বাসটা। আমি জানি না নাক ডাকা লোকটা যখন পাশে এসে বসেছিল তখন কেমন দেখতে  ছিল — কিন্তু, পোশাকের বিটকেল গন্ধের আভাস দিয়ে, অসহনীয় গ্লানির অনুভূতি আমার চারিদিক ঘিরে ধরেছিল।

—স্যার, আপনার কাঁধে মাথা রেখে যে লোকটা ঘুমোচ্ছিল, সে এই স্টপেজে নেমে গেল, কিন্তু ওর মাথাটা আপনার কাঁধেই রয়েছে । দূরপাল্লার বাসের কন্ডাক্টার গদাধরের ঘুমন্ত কাঁধে নাড়া দিয়ে বলল।

ড্রাইভার বলল, তাহলে ঠিক আছে, আমি বাসটাকে ফ্লাইট মোডে নিচ্ছি, অটো পাইলট সেট করে । আপনারা এবার নক্ষত্রর গুঁড়ো হাত বাড়িয়ে তুলতে পারবেন, মুখে মেখে নিলে অন্ধকারে একে আরেকজনকে দেখতে পাবেন।

—–মৌলবাদ আর  শিল্প পরস্পরবিরোধী। মৌলবাদী শিল্প বলে কিছু হয় না। তার মানে এই নয় যে মৌলবাদী সৃজনশীল নয়। বরং তার সৃজনশীলতা হলো ডিগবাজির । মৌলবাদী ঘৃণার আর ধ্বংসের সৃষ্টি করে। কাঁধের মাথাটা বলল গদাধরকে ।

একজনের কাঁধে আরেকজন মাথা রাখছে আর দুজনের একজন বাস থেকে নেমে চলে যাচ্ছে, মাথাটা অন্যের কাঁধে পড়ে থাকছে, এরকম ঘটনা ঘটেই চলেছে, শুধু এইরুটে নয়, গলগণ্ডপুরমের সব রুটে , দুজনের একজন নাকি শহীদ হয়ে যাচ্ছে । বলল ড্রাইভার।

কন্ডাক্টারকে একজন দুই-মাথা কাঁধে হেলান দিয়ে বলল, এখন  শুনুন। আসলে ফ্যারাওরা যখন মিশর থেকে যে লোকজনদের তাড়িয়ে দিয়েছিল, তারাই প্রথম একটা বই পেয়েছিল যেটা মানুষের লেখা নয় । মানুষের লেখা বই থেকে মানুষ কেমন করে জন্মাবে, বলুন ড্রাইভার সাহেব । আমাদের ঋগ্বেদ ছাড়া গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, মেঘনাধবধ কাব্য, সুবিমলমিশ্রর বইসমগ্র আছে, একটা বইই নয় । যাদের একটাই বই আছে আর তা মানুষের লেখা নয়, তাদের বই থেকে সবকিছু জন্মেছে । আমরা আর আফরিকার কিছু বুনো মানুষ বই থেকে জন্মাইনি। 

—আপনি কি বাঙালি ? এই পারের বাঙালিরা বলে যে ওরা বই থেকে জন্মায়নি অথচ ওই পারের বাঙালিরা বই থেকে জন্মেছে ! এটা কি অক্সিমোরোন ? তাও আবার বাংলা বই থেকে নয় । আরবি বই থেকে।

—আরবি বই থেকে জন্মাতেই পারে । আমি সত্যিই যা চাই তা হল ছোটো-ছোটো হরফ, দুর্বোধ্য শব্দে ঠাসা কঠিন বাক্য, অনেক অক্ষরের শব্দ আর লম্বাই-চওড়াই মার্কা ধারণা, বেশ মোটা হাজার পাতার বই, এমন লেখখের  লেখা বই যে কিনা হাওয়া দিয়ে গড়া । 

—আজকাল শতকরা আশিভাগ যুবতীরা বিয়ের বিরুদ্ধে। কেন জানেন ? কারণ যুবতীরা বুঝতে পেরে গেছেন যে সামান্য সসেজ পাওয়ার জন্য একটা পুরো শুয়োর  কেনার কোনো মানে হয় না! পেছনের সারিতে বসে ছিলেন এক বুড়ির কাঁধে মাথা রেখে দেহহীন যুবতী, তিনি বললেন কথাগুলো।

বুড়ি বলল, এই ছুঁড়ি, তোর তো বডি নেই, সসেজ নিয়ে করবিটা কী ?

যুবতী বলল, যে কোন প্রাণী চোদাতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র মানুষই যৌন আবেগ অনুভব করতে পারে, যা সঙ্গমের জৈবিক তাগিদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আর যৌন আবেগ সহস্রাব্দ ধরে মানব জীবনের একটা অত্যাবশ্যক মানসিক শক্তি হিসাবে মনে করা হয় । সাধারণ পুরানো সহবাস শুধুমাত্র সেইসব পয়েন্টে ইরোটিকভাবে ঠাটিয়ে ওঠে আর আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে যেখানে প্রতিবন্ধকতা, দ্বন্দ্ব, নিষেধাজ্ঞা এবং পরিণতি এটিকে একটি দ্বি-ধারী চরিত্র ধার দেয় – অর্থপূর্ণ যৌনতা  পরাজিত  আত্মসমর্পণ, একটা অতিক্রম আর লঙ্ঘন, বিজয়ী আর ভয়ঙ্কর এবং আনন্দিত এবং দুঃখজনক।  শুধুমাত্র মানুষই ইচ্ছা হলে করে নয়তো করে না। সীমালঙ্ঘন করতে পারে, পরাস্ত করতে পারে, ভালোবাসতে পারে: বেছে নিতে পারে।

—যাঁরা হাত বাড়িয়ে নক্ষত্রের গুঁড়ো গায়ে মাখলেন, তাঁরা কিন্তু, এই যাত্রার আইনভঙ্গ করলেন, কেননা, বাসের যাত্রীদের সবাই ল্যাংটো বা নগ্ন থাকবেন এই শর্তে তোলা হয়েছিল । বলল কন্ডাক্টার ।

—কেন ? জানতে চাইল গদাধর ।

ড্রাইভার বলল, ঈশ্বর প্রথম যুবক আর প্রথম যুবতীকে  বললেন, ফলবান হও আর সংখ্যাবৃদ্ধি কর, তাই আমি তোমাদের গায়ে পোশাক দিইনি। একে অপরের সাথে যৌনমিলন করো বা  গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে একে অপরের সাথে যৌনমিলন করো, বা কামসূত্র থেকে কিছু আকর্ষণীয় জিমন্যাস্টিক নিয়ে এসো ।

—দেখুন, আপনারা যাকে ঈশ্বর ভাবছেন, তা হলো রাষ্ট্র । অনেকগুলো রাষ্ট্র হবার পর ঈশ্বরদের সংখ্যা বেড়ে গেছে ।

চতুর্থ পর্ব

গায়ে নক্ষত্রের রুপোলি গুঁড়ো মাখার পর যাত্রীরা টের পেলো তাদের অকুস্হলে যৌন অঙ্গ নেই । তাদের বিদেশী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, তাদের ব্যঙ্গগত এবং ভাষাগত পরিবর্তনের কারণে, তারা প্রভাবশালী মূল্য ব্যবস্থার জন্য হুমকি হিসাবে দেখা দেয়, প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল দুই পক্ষেই ।

এখন কী করবে ওরা সবাই ?

বাস কন্ডাক্টার বলল, তখন ১৯৭৯ সাল । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে সরকারি টাকায় একটা টুকিটাকির দোকান খুলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলুম। টিভিতে দেখলুম চৌঠা এপ্রিল পাকিস্তানের লোভি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে রাওয়ালপিন্ডির জেলখানায়, আজেবাজে দোষ লোকটার ঘাড়ে চাপিয়ে। কোনো মানে হয় না । লোকটার আসল দোষ ছিল ওদেরই পাবলিক পাকিস্তানি সেনাদের থুথু করছিল ভুট্টোর দোষে আর পাঞ্জাবি সেনারা  ওদের দেশের বাঙালিদের লোপাট করে দিচ্ছিল । মজার ব্যাপার হলো যে পাকিস্তানের সেনা প্রশাসন ওর প্রাণদণ্ডাদেশ দিয়েছে। শালা নব্বই হাজার পাকিস্তানি সেনা নিজেরা ধরা দিয়েছিল, নানা কুকীর্তি করার পর। ভুট্টো কড়া ঘুমের ওষুধে ন্যালব্যাল করছিল বলে ওকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাতে হয় ।ওর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের পর ওর বউ নুসরাত আর মেয়ে বেনজির  প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিল ওদের রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হকের কাছে। তা জিয়াউল হক শুনবে কেন ? ওই তো ভুট্টোকে রাত দুটোয় ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল আর জেলের পেছনের দরোজা দিয়ে লাশ নিয়ে গিয়ে কবর দেবার ব্যবস্হা করেছিল।

ড্রাইভার বলল, আমরা তো আল বদর, আল শামস আর রাজাকরদের ধরেধরে প্যাণ্ট খুলে পোঁদে এতো লাথি মেরেছিলুম যে নিজেদেরই পা ব্যথা করছিল । পাকিস্তানি সেনাদের অমন অপমান করার হুকুম ছিল না কেননা ওরা প্রিজনার অফ ওয়ার । তবু, যেকটা এদিক সেদিকে একা ধরা পড়েছিল সেগুলোকে শহর গাঁয়ের পাবলিকই শায়েস্তা করেছে । 

গদাধর বলল, সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবার ইচ্ছে আমার ছোটোবেলা থেকেই ছিল। তাই কলেজে পড়ার সময়ে ন্যাশানাল ক্যাডেট কোরের ইনফ্যান্ট্রিতে যোগ দিয়ে থ্রি নট থ্রি, বাইশ বোরের রাইফেল, স্টেনগান আর পিস্তল চালাতে শিখেছিলুম । তা সত্বেও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারলুম না তার কারণ শারীরিক সক্ষমতা যাচাই করার এই পরীক্ষাগুলোয় অন্যদের থেকে ভালো ফল করতে পারলুম না, বা বলা যায় ফেল করলুম: ছয় কিলোমিটার দৌড়, বিমের ওপর পুশ-আপ, নয় ফুট গর্তের মধ্যে দিয়ে যাওয়া আর জিগজ্যাগ ব্যালেন্স। আসলে প্রতি বছর তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ লক্ষ ছাত্রছাত্রী সেনায় যোগ দেওয়ার আবেদন করে। তার কারণ এই কেরিয়ারে রয়েছে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা, দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ, আকর্ষণীয় বেতন, অ্যাডভেঞ্চার, আত্মত্যাগের হাতছানি। 

আপনি পাকিস্তানিদের প্যাঁদাতে যাননি ? গদাধরের কাঁধের মুণ্ডুটা জিগ্যেস করল ।

—-দিয়েছিলুম তো, বলল গদাধর, তারপর যোগ করল, সেনায় যোগ দেবার আশা যখন ছেড়ে দিয়েছি, ১৯৭১ সালের এপ্রিলে একজন লোক এসে জানতে চাইল আমি সেনার হয়ে কাজ করতে চাই কিনা, আর একটা কাগজ দিয়ে বলল, রাজি থাকলে এই ঠিকানায় কালকে সকাল ছয়টায় হাজিরা দিতে । পরের দিন পৌঁছে দেখলুম, আমার বয়সী অনেকে এসেছে । আমাদের শপথ করিয়ে বলা হলো যে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ লাগবে আর তার জন্য সেনার দরকার বেসরকারি যোদ্ধা আর গুপ্তচর । আমরা কুড়িজন, সবাই বাঙালি, একদিন বাসে চেপে হাজির হলুম একটা ক্যাম্পে। বাসটা সেনার ছিল না আর ক্যাম্প দেখেও টের পাবার উপায় নেই যে ওখানে ভবিষ্যতের কোনো লড়াইয়ের জন্য ট্রেনিঙ দেয়া হচ্ছে ।

একজন বুড়ির কন্ঠস্বর শোনা গেল বাসের পেছন দিকের সিট থেকে। বলল, পৃথিবীতে মানুষের জীবন যাপনের দিক নির্দেশনা এবং সাম্য-মৈত্রীর বাণী নিয়ে যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মের আগমন ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারতবর্ষ হচ্ছে ধর্মের আদিভূমি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধর্মের নামে মানুষ রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে আবার এই ধর্মই মানুষকে করেছে সুসংহত, মানবতাবাদী। এছাড়া মানবধর্ম রয়েছে যেটা নাস্তিকরা পালন করে। তারা কোন ধর্মকেই বিশ্বাস করে না,তাদের মতে বিজ্ঞান ও আধুনিক পৃথিবী,তাদের জন্ম হয়েছে বির্বতনের মাধ্যমে এটাই তাদের বিশ্বাস। আর এখন এই উড়ন্ত বাসে আমরা সবাই লিঙ্গহীন হবার পর ধর্মের বা মানুষের উৎপত্তির ইতিহাস জানার দরকার নেই ।

—এই তো ! কিছুক্ষণে একটা গ্রহে গিয়ে উড়ন্ত বাসটা নামাবো আর আপনারা অন্য রকমের যৌন অঙ্গ ফিরে পাবেন । তখন নতুন বসতি গড়তে পারবেন আর সৃষ্টি করবেন ঈশ্বর-দেবী-দেবতা-ঈশ্বরপুত্র বা যা চাইবেন তাই । কথাগুলো কে বলল টের পাওয়া গেল না ।

বাসটা নতুন একটা গ্রহে নামার পর সবাই দেখল গেটের কাছে একজন লোক রবিঠাকুরের আলখাল্লা পরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে । লোকটা বলল, আমি একা এই গ্রহে থাকি । আপনাদের জন্য একটা বুলেটিন লিখে রেখেছি । এর নাম হাংরি বুলেটিন । এই গ্রহে সংসার পাতুন আর এই বুলেটিনের কমাণ্ডমেন্টসকে প্রতিষ্ঠা করুন।

গদাধর বুলেটিন হাতে নিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে পড়ে শোনালো 

১. বস্তুসমুহের গুণরাজি মনেরই আরোপিত, মনেই তাদের অবস্থিতি, মন দিয়েই তারা নির্মিত। আমরা যেমন ভাবি, ঠিক তেমনি রুপান্তরিত হই। তাই দূষিত মনে কেউ কিছু বললে বা করলে দুঃখ তার অনুগমন করে, যেমন গাড়ির চাকা বাহক বলদের অনুসরণ করে।
২. বস্তুসমূহের গুণরাজি মনেরই আরোপিত, মনেই তাদের অবস্থিতি, মন দিয়েই তারা নির্মিত। প্রসন্ন মনে যিনি কতাহ বলেন বা কাজ করেন সুখ তাকে নিরবচ্ছিন্ন ছায়ার মত অনুসরণ করে।
৩-৪. আমার প্রতি আক্রোশ করল, আমায় মেরে ফেলল, আমাকে অন্যায়ভাবে হারাল, আমারটা ছিনিয়ে নিল; সবসময় যাদের এই চিন্তা, তাদের মন থেকে বৈর-ভাব কখনো দূর হয় না। আমার সঙ্গে শ্ত্রুতা করল, আমায় মারল, আমারটা হারাল, আমারটা নিল; এই সব চিন্তা যারা মনে স্থান দেন না, তাদের বৈরভাব দূর হয়ে যায়।
৫. শত্রুতা দিয়ে কখনো শত্রুতার মীমাংসা হয় না। শত্রুহীনতা দিয়েই এর প্রশমন সম্ভব; এই হল সনাতন ধর্ম।
৬. মূর্খরা জানে না যে তারা চিরকাল এই সংসারে থাকবে না। যারা জানেন তাদের সব কলহের শান্ত হয়।
৭-৮. যে কেবল বাইরের সৌন্দর্য খুজে বেড়ায়, যার ইন্দ্রিয় সংযত নয়, অতিভোজনকারী, অলস আর হীনবীর্য, সে বাতাহত দুর্বল গাছের মত মারের কাছে পরাজিত হয়। দেহের মলিনতার কথা জেনে যে বাইরের শোভা খোজে না, যে ইন্দ্রিয় জনযত রাখে, পরিমিত আহার করে, সেই শ্রদ্ধাবান ও বীর্যবান ব্যক্তিকে রসবিত করতে পারে না-বাতাস যেমন শিলময় পর্বতকে নাড়াতে পারে না, ঠিক তেমনি।
৯-১০. যৌন আসক্তিতে যে আসক্ত, সে কাষায বস্ত্র পরিধান করা, তথা ভিক্ষু হয়ার যোগ্য নন। যিনি কাম, রাগ ইত্যাদি দোষ মুক্ত, শোলসমূহে সুপ্রতিষ্ঠিত, সংযমী, সত্যনিষ্ঠ তিনিই কাষায় বস্ত্র তথা নাগরিক হয়ার যোগ্য।
১১-১২. যা অসার বা অসত্য তাকে যারা সার বা সত্য মনে করে, আর সারকে অসার মনে করে, মিথ্যা সংকল্পের সেই আশ্রয়দাতারা কখনো সত্যকে লাভ করতে পারে না। অন্যদিকে যারা ঐ অসত্যকে অসত্য বলেন আর শীল প্রভৃতি সার বস্তুকে সার বলে জানেন তারাই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে মুক্তিপথ লাভ করেন।
১৩-১৪. যে ঘর ভালভাবে আচ্ছাদিত নয়, তার মধ্যে যেমন বৃষতি ঢুকে পড়ে, তেমনি যে চিত্ত ধ্যানপরায়ণ নয় তাতেও রাগ (আসক্তি) প্রবেশ করে। ভালভাবে আচ্ছাদিত ঘরে যেমন বৃষ্টি ঢুকতে পারে না, ভাবনামুক্ত চিত্তে চেমনি আসক্তি প্রবেশ করতে পারে না।
১৫. যে পাপ করে, সে ইহলোকে ও পরলোক, দুই জায়গাতেই অনুশোচনা করে। নিজের দুষ্কর্ম দেখে সে শোক করে আর কষ্ট পায়।
১৬. যিনি কৃতপুণ্য, তিনি ইহলোক ও পরলোক, উভয় স্থানেই আনন্দ লাভ করেন। তিনি নিজের সুকৃতি দেখে পরম আনন্দ পান।
১৭. পাপী ইহলোক ও পরলোক, উভয় স্থানেই অনুতাপ ভোগ করে। আমি পাপ করেছি – এই চিন্তা তাঁকে যেমন দগ্ধ করতে থাকে, তেমনি পাপেরর ফলে দুর্গতি লাভ করে সে আরো দুঃখ পায়।
১৮. যিনি পুণ্য কাজ করেছেন, তিনি ইহলোক ও পরলোক, দুই জায়গাতেই আনন্দিত হন। আমি সৎ কাজ করেছি – এই চিন্তায় যেমন তাঁর আনন্দ হয়, তামনি সুগতি লাভ করে তিনি আরো আনন্দ পান।
১৯-২০. যে বহু বই-গ্রন্থ-শাস্ত্র পড়ে কিন্ত সেই জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করে না, সে ঠিক সেই রাখালের মত, যে অন্যের কয়টা গরু মরল তা নিয়েই পড়ে থাকে, বৈরাগ্য/শ্রামণ্য তাঁর জন্য নয়। শাস্ত্র অল্পমাত্র উচ্চারণ করলেও যিনি জীবণে তা ধারণ করে রাগ, দ্বেষ ও মোহ থেকে মুক্ত হন, সম্যক জ্ঞানের অধিকারী, বিমুক্তচিত্ত এবং ইহলোক ও পরলোকে উপাদান-রহিত তথা কামশূন্য হন, তিনিই শ্রামণ্যের ফল ভোগ করেন।

২১. যে যার আরাধ্য দেবী-দেবতা-ঈশ্বর-শয়তান-দৈত্য-দানব সৃষ্টি করে বই লিখুন । আসল কথা হলো বই। কে লিখেছে তার কোনো গুরুত্ব নেই ।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

মলয় রায়চৌধুরীর অনুগল্প : মল, মালটিপ্লেক্স, চোদ্দ শাক

ইনারবিট মলের ফুড কোর্টে বসে অপেক্ষা করছিলুম এক দম্পতির, যাঁরা তাঁদের বিবাহবার্ষিকীউদযাপন করার জন্য আমাদের কয়েকজনকে মেইনল্যান্ড চায়নায় ডিনার করাবেন । নিমন্ত্রিতরা সবাই এসে পৌঁছোয়নি বলে গ্যাঁজাচ্ছি । একজন অচেনা সুশ্রী যুবতী এগিয়ে এলেন ; ভাবলুম তিনিও নিমন্ত্রিত । কিন্তু তিনি আমার কাছে এসে একটা লাল রঙের বই খুলে বললেন, ইংরেজিতেই বললেন,— এই ধরণের মলে ঢুকলে সকলেই দেখি মাতৃভাষা ভুলে যায়—“স্যার, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছেআপনি বাঙালি ; কাইন্ডলি বলুন এই গ্রিনগুলোর ইংরেজি কী? এখানের ভেজি-মার্কেটে কেউ বলতে পারল না ; পাওয়াও যাচ্ছে না কোথাও , আমি ক্রফোর্ড মার্কেটে খোঁজ করেছিলাম, ওরা বলল যে ইনঅরবিট মলে পাবো ।”

আমি বললুম, এটা তো বাংলা পাঁজি ? পাঁজি কোথায় পেলে ? ইনঅরবিট মলে পাঁজিও পাওয়া যায় নাকি ?যুবতী বললে, “না স্যার, ঠাকুর ভিলেজের মাছের দোকান থেকে কিনেছি ।” ঠাকুর ভিলেজ জানি, গ্রাম নয়, উচ্চবিত্তদের এলাকা । নিউ ইয়র্কের গ্রিনিচ ভিলেজ যেমন গ্রাম নয় ।

–মাছের দোকানে পাঁজি ? এই চালুনিও সেখান থেকে কিনেছ ? আজকাল তো আটা চালার ব্যাপারটা উঠেই গেছে ।

–হ্যাঁ স্যার । কয়েকটি মুসলমান ছেলে মেদিনীপুর থেকে এসে মাছের দোকান খুলেছে, তারা বাঙালির প্রয়োজনের সব জিনিস বিক্রি করে ।

মেয়েটিকে দেখে অবাঙালি মনে হচ্ছিল । যদিও সব যুবতীই আজকাল জিনস আর টপ পরে বেরোন । দুহাতে মেহেন্দি আঁকা । এক হাতে দামি ব্যাগ আর একটা চালুনি, অন্য হাতে পাঁজি । দামি পারফিউম লাগিয়ে থাকবে ।

বললুম, তুমি বাঙলা পড়তে পারো না ?

মেয়েটি বসল পাশের চেয়ারে । ব্যাগ আর চালুনি রাখল টেবিলের ওপর । পাঁজিটা মেলে ধরল । বলল, আমি কানপুরের মেয়ে, আমার হাজব্যাণ্ড বাঙালি । চালুনি কিনেছি করওয়া চৌথ অনুষ্ঠানের জন্য, প্লাসটিকের ইউটেনসিলের দোকান থেকে । আর এই রেড বুকে লেখা ফোরটিন গ্রিনস কিনতে বেরিয়েছি আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির জন্য, সেই সকাল থেকে বেরিয়েছি । আমায় কিনতেই হবে, এটাআমার বিয়ের প্রথম বছর; ওনাদের ইমপ্রেস করার জন্য আমি এই ফোরটিন গ্রিনস যোগাড় করবই ।

“পাঁজিতে ফোরটিন গ্রিনস আবার কী জিনিস ?” জানতে চাইলেন আমার একদা এক সহকর্মীর স্ত্রী । সহকর্মীও অবসর নিয়েছেন । পাঁজিটা নিয়ে তিনি পাতা ওলটাতে-ওলটাতে বললেন, কতোকাল পরেবেণিমাধব শীলের পাঁজি দেখছি, বেশ নসটালজিক লাগে । সবায়ের নসটালজিক হাত ঘুরে পাঁজিটা আবার আমার কাছে এলো ; আমার চুলে বেশি পাক ধরেছে বলে সম্ভবত। মেয়েটি যে পাতাটায় পেজ মার্ক দিয়ে রেখেছে, সেখানে ফোরটিন গ্রিনসগুলো হলুদ রঙে হাইলাইট করা ।

সবাইকে পড়ে শোনালুম ফোরটিন গ্রিনসের নামগুলো, যদি কেউ কোনো হদিশ দিতে পারে । ভুত চতুর্দশীতে খাবার জন্য চোদ্দ শাক : ওলপাতা, কেঁউ, বেতো, সরিষা, কলকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা আর সুষণী ।

শুনে, সকলের মুখের মুচকি হাসিতে যুবতীটি বিব্রত বোধ করলে, আমার স্ত্রী মেয়েটির থুতনি ধরে আদর করে বলল, “এই ফোরটিন গ্রিনসের তিনচারটি ছাড়া মুম্বাই কেন তুমি কলকাতার বাজারেও পাবে না । তোমার শ্বশুর-শ্বাশুড়িও এই গ্রিনসের সব কয়টি দেখেছেন বলে মনে হয় না । আমরা কলকাতায় বহুদিন ছিলুম, চোদ্দশাক বাজারে বিক্রি হয় ভুতচতুর্দশীতে, কলমি, পুঁই, পালঙ, নটে, লাউ, কুমড়োশাক কুচোনো, তারসাথে হয়তো দুচারটে নিম আর সুষণী পাতা । উত্তরপাড়ার বাজারেআমার গোঁড়া শ্বশুরমশায়ও খুঁজে পাননি কখনও । আমি তো এই প্রথম শুনছি শাকের নামগুলো ।আমার শ্বাশুড়িও ভুতচতুর্দশী করতেন, ফোরটিন গ্রিনস দিয়ে নয়, দুতিনরকম শাকের চোদ্দ টুকরো । যা শাক পাও কিনে শ্রেডিং করে নাও, ব্যাস, ইয়োর ইনলজ উইল বি হ্যাপি ।”

আমার সহকর্মীর স্ত্রী, এক সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন, বললেন, রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দেও বোধহয় এই গাছাগাছালির নাম নেই ।

আমি ভাবছিলুম, ভুতচতুর্দশিতে যে এই শাকগুলো খেতে হয় তা-ই তো জানতুম না ।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

মলয় রায়চৌধুরীর অনুগল্প : যে হাত প্রেমের উচ্ছন্নে টেনে তোলে

যে হাত প্রেমের উচ্ছন্নে টেনে তোলে

মাটিতে শাল বা শিশুকাঠের গুঁড়ি পুঁতে তাকে পাকিয়ে-পাকিয়ে চারতলা পর্যন্ত উঠে গেছে বাঁশের রেলিঙ আর কঞ্চির ধাপ দেয়া কাঠের সরু সিঁড়ি , এতই সরু যে একজন যদি নামতে থাকে তাহলে তাকে জায়গা দেবার জন্য রেলিঙে হেলে দাঁড়াতে হবে । তা সত্ত্বেও স্পর্শ বাঁচানো কঠিন । স্হান সংকুলানের জন্য দুই পাক ওঠার পর একতলা, তার পর দুই পাক উঠে দু’তলা, এইভাবে পাক খেয়ে চারতলা পর্যন্ত টালির চালে তৈরি কাঠের বাড়ি । অর্থাৎ সিঁড়িটা কেবল সরু নয়, তা বেশ প্যাঁচালো । প্রতিটি তলায় সিঁড়ির মুখে বাঁ’দিকে একটা ঘর আর ডান দিকে খোলা , কাঠের সরু করিডরে যাবার জন্য ; করিডরের একদিকে কাঠের ঘরের সারি , আরেক দিকে খোলাবারান্দা । বারান্দা থেকে ভেতরের উঠোন দেখতে পাওয়া যায় । ঘরের মেঝেও কাঠের, দুটি জানালার শিকগুলোও কাঠের । জানালাগুলো বিশাল, দরজার মাপেই । ঘরগুলো বারো বাই আট হবে । গ্রাউন্ড ফ্লোর বা একতলা ছাড়া ওপরের তলাগুলোয় আসবাব কম ; প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে আসবাব ওপরে ওঠানো কঠিন । বিছানা বলতে মাটিতে খড়ের আঁটি বিছিয়ে তার ওপর চাদর পাতা । ঘরভাড়া মাথা-প্রতি মাসে একটাকা ,যা সংগ্রহ করতে সামন্তের পেয়াদা আসে মাসের এক তারিখে । পাড়াটার নাম ঠমেল—তার রূপ সম্পূর্ণ বদলে গেছে গত কয়েক দশকে ।

অমন গুঁড়ি পুঁতে-পুঁতে , পঞ্চাশ মিটার বাই একশো মিটার জুড়ে একটা আয়তাকার উঠোন ঘিরে জনপ্রাসাদ । এই প্রাসাদের মূল দরজা একটিই এবং সেটি সদাসর্বদা খোলা ; দশ ফিট উঁচু চার ফিট চওড়া কাঠের ফ্রেমে কাঠের ক্ষয়াটে জনপ্রাসাদের সংদরজা । কতজন থাকতেন এই বাড়িটিতে অনুমান করা যেত সকালবেলায়, যখন উঠোনে জড়ো হতেন অনেকে প্রাতঃকৃত্য সারার জন্য, স্নানের জন্য । এই জনপ্রাসাদের সবাই প্রত্যেকদিন স্নান করতেন না বলে সুবিধা , প্রাতঃকৃত্য বলা হলেও সবাই সকালেই যেতেন না , অ্ভ্যাসমতো যেতেন । প্রতিদিন স্নান করার ব্যাপারটা আমিও বাদ দিয়েছিলুম । এই কুটিরপ্রাসাদে গরিব নেপালি ও নেওয়ারি পরিবার যেমন থাকতেন তেমনই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন হিপির দল, নেপালি কবি-লেখক-শিল্পী, আর ভারত থেকে আসা আমাদের মতোন উচ্ছন্নাকাঙ্খীরা । গ্রাউন্ডফ্লোরে, দু-তিন ঘরের ফ্ল্যাটে থাকতেন মধ্যবিত্তরা । একজন নেপালি অভিনেত্রীও থাকতেন ।

আমি ষাটের দশকের কথা বলছি , যে সময়ে ফান, ফুড, ফ্রিডাম, ফ্রিকাউট এবং ফাকিঙের উদ্দেশ্যে দলে-দলে তরুণ-তরুণী আমেরিকা-ইউরোপে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন ; লন্ডন বা অ্যামস্টারডম হয়ে বাসে, ট্রেনে, আর হিচহাইক করে তুরস্ক, ইরান, আফগানিসতান, পাকিস্তান , ভারতবর্ষ হয়ে শেষ গন্তব্য নেপাল । লন্ডন আর অ্যামস্টারডম ছিল স্বাধঃপতিতদের জড়ো হবার ঘাঁটি । ভারত-পাকিস্তানের যে গেট দিয়ে তাঁরা আসতেন তার নাম ছিল গন্দাসিং ওয়ালা, তখনও ওয়াগার গেট হয়নি , পাকিস্তানের সঙ্গে এখনকার মতোন বোমাবুমির সম্পর্কও হয়নি , চিনের যুদ্ধ সত্ত্বেও । এই যাত্রাপথের নাম ছিল শামুক-গতির হিপি ট্রেইল , যে যাত্রাপথ ছিল যথেচ্ছাচার ও মহানন্দে সময় কাটাবার সহজ উত্তরণ । সে-সময়ে ইউরোপ-আমেরিকায় যুবক-যুবতীরা চাইলেই চাকরি পেতেন অথচ বাড়ি ছেড়ে দলে-দলে বেরিয়ে পড়তেন । এখন চাকরি পাওয়া কঠিন , তবুও কেউ বেরিয়ে পড়েন না , তার কারণ পৃথিবীটা হয়ে গেছে ঝগড়াটে , খেঁকুরে, লোভী , জোচ্চোর ও মতলববাজ । শান্তির কোনো ট্রেইল আর নেই, দেশগুলোও অশান্ত ! পৃথিবীর অত্যন্ত ধনী এলাকাগুলোই কেবল শান্তিতে রয়েছে ।

ফ্রিকিং আউট হবার জন্যই কাঠমান্ডুতে জড়ো হতেন হিপি-হিপিনীরা , নেপালে চরস গাঁজা ভাঙ ইত্যাদি পথেঘাটে পাওয়া যেত বলে । ১৯৮০ র পর আমেরিকার চাপে প্রতিটি দেশে আইন করে ভেষজ মাদকসহ সব মাদক নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে । আমেরিকার বিজ্ঞানীরাই ভেষজ থেকে রসায়ন বের করে মাদককে কড়া আর বাজারু করে দিয়েছেন । আর ওই রসায়নেই ড্রাগ অ্যাডিক্ট নামক জীবদের জন্ম । হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীরা এখনও ভেষজের ধোঁয়া ফুঁকে চলেছেন কিন্তু কেউই অ্যাডিক্ট হন না ।

হিপিরা বেরিয়ে পড়ার পথে আফগানিস্তান থেকে আনতেন উচ্চমানের চরস বা হ্যাশিশ আর পাকিস্তান থেকে গাঁজাপাতার গুঁড়ো যাকে পাকিস্তানিরা বলতেন গরদা । নেপালি গাঁজার সঙ্গে হ্যাশিশ আর গরদা মিশিয়ে তৈরি হতো একরকমের ডেডলি মাদক । হিন্দু বা বৌদ্ধ , যেকোনো মন্দির চত্বরে গেলে দেখা যেত বৃদ্ধ মাদকসেবীরা গোল হয়ে বসে ছিলিম টানছেন ; তাঁদের পাশে বসে পড়লেই হলো, একখানা ফ্রি লম্বা টান দেবার জন্য । আর হিপি-হিপিনীরা তো ছিলই দরিয়াদিল ; চাইলে নিজেদেরই বিলিয়ে দেবার জন্যে তৈরি । স্বয়ম্ভূনাথ মন্দিরকে হিপিরা বলত মাংকি টেম্‌পল আর এই বৌদ্ধমন্দির ঘিরেই ছিল তাদের জমায়েত , নেশা করে নির্বাণপ্রাপ্তির প্রাঙ্গন ।

স্হানীয় তরুণ কবিরা পছন্দ করতেন কান্ট্রি লিকার, বিশেষত রাকসি এবং জাঁড় , যা খাওয়া হতো মাংসের আচার দিয়ে । অনেক সময়ে মোষের কাঁচা মাংস চটকে-চটকে তৈরি করা কাচিলা দিয়ে । রাকসির গন্ধ অত্যন্ত ঝাঁঝালো ; বহুদূর পর্যন্ত যায় তার নিশিডাক । এই কবি-লেখকরা স্হানীয় সংবাদপত্রে আমাদের সম্পর্কে লিখে অনেককিছু সহজলভ্য করে দিয়েছিলেন । প্রায়ই নিমন্ত্রণ আসতো কবিদের রাকসি-পান আড্ডায় কবিতাপাঠের জন্য ।

আমিও ওই জনপ্রাসাদটিতে থাকতুম । জুটেছিলুম গিয়ে বন্ধু করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের ডাকে । করুণা আর চিত্রশিল্পী অনিল করঞ্জাই গিয়েছিল বেনারস থেকে । হিপিরা ভারতে এসে উঠত বেনারসে । সেই সুবাদে করুণা হয়ে উঠেছিল ওদের গাইড এবং দরকার পড়লে স্লিপ-ইন পার্টনার । বেনারসে ওই সময়ের জীবন নিয়ে আমি একটা উপন্যাস লিখেছিলুম , ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ নামে, যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিষয়মুখ’ পত্রিকায় আর পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল ‘তেহাই’ পত্রিকায় । নেপালের জীবনযাত্রা নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে । ‘টাইম’ পত্রিকায় আমার ফোটো বেরিয়েছিল বলে, আর আমার সঙ্গে বিটনিক কবি গিন্সবার্গ ও ফেরলিংঘেট্টির পরিচয় আছে এবং বিটনিকদের পত্রপত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশিত হবার দৌলতে আমার নাম জানতেন হবু-কবি হিপি-হিপিনীরা । সেকারণে মাদকের ও যৌনতার একটি বিভাময় হ্যালো ওনারা গড়ে দিয়েছিলেন আমার মাথাকে ঘিরে । জীবন হয়ে উঠেছিল অবাধ ও সীমালঙ্ঘনময় ।

আমার সবচেয়ে বেশি সমস্যা হত মাদকের নেশা করে রাতের বেলায় ওই প্যাঁচালো সিঁড়ি দিয়ে নিজেদের ঘরে যাওয়া । আমি রাতে ফিরে প্রায়ই গুলিয়ে ফেলতুম । আমরা ছিলুম দোতলায় । কতবার ঘোরার পর দোতলায় যাব তা খেয়াল রাখতে পারতুম না । প্রত্যেকদিন বাঁদিকের কারোর ঘরের কাছে পৌঁছে টের পেতুম যে, এটা নয় , নিচে বা ওপরে গিয়ে ডানদিকে যেতে হবে । কারোর কারোর দরজায় ঝোলানো থাকত পরদা, বেশ নোংরা , মনে হত যে পরদাতেই হাত পোঁছে ভাড়াটেরা । অবশ্য হিপিদের ঘরে গিয়েও খড়ের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া যেত, বিনা বাধায় ।

মদ খেলে লোকে টলতে থাকে । ভেষজের নেশায় যা ঘটে তাকে বোধহয় বলা উচিত ভাসতে থাকা বা উড়তে থাকা । ছাদ থেকে ফেলে দেয়া ফালিকাগজের মতোন । একদিন রাতে ফিরে সিঁড়ির পাক গুলিয়ে ওপরে গেলুম, টের না পেয়ে নেমে এলুম, আরও কয়েকবার অমন ওঠা-নামা করার পর, উঠছি, একটি বাঁদিকের ঘর থেকে পরদার মাঝ দিয়ে স্বাস্হ্যবতী নারীর ডান হাত বেরিয়ে এলো, সবুজ কাঁচের চুড়ি, লাল রঙের ব্লাউজের হাতা, এক হ্যাঁচকায় ভেতরে টেনে মহিলা নেপালি-টানের হিন্দিতে বললেন, ‘রোজই দেখি দরজা অব্দি আসো , ফিরে যাও কেন ?’ 

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

মলয় রায়চৌধুরীর অনুগল্প : স্মাইলিঙ লিপস

স্মাইলিঙ লিপস

রাস্তারদু’ধারে ভয়ে-ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে টাওয়ারগুলো । একটা বিল্ডিং কত তলার পর ওপরেউঠে টাওয়ার হয় ? টাওয়ার হয়ে উঠলেই তাদের ভয় করতে থাকে । আমার মনে হয়উনিশতলা পর্যন্ত তারা টিন এজার থাকে । টাওয়ারগুলো ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে এইজন্য যে কখন কোন গৃহবধু কোনো বিশাল কাচের জানলা বা বারান্দা বা ছাদে গিয়েহাওয়ায় দুহাত ভাসিয়ে দেবেন। এরকমই ঘটছে কয়েক মাস যাবত । এক গৃহবধু তার দুই ছেলেকে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলেদিলেন আর তারপর নিজে লাফ মারলেন। কারণ ? শ্বশুরবাড়ির লোকেদের দুর্ব্যবহার ।আরকটি গৃহবধু কোলে ছেলেকে নিয়ে লাফিয়ে পড়লেন । কারন সেই একই । কিন্তু একজনগৃহবধু, সংবাদপত্র অনুযায়ী, ছেলেপুলে স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে সুখেইছিলেন , লাফ মারলেন হঠাৎই । সবাই ডাইনিং টেবিল ঘিরে খেতে বসেছিলেন । তিনিউঠে গেলেন, কাচের জানালা খুললেন । পরিবারের সদস্যরা ভাবলেন তিনি একটুসামুদ্রিক বাতাস উপভোগ করতে চাইছেন । কেউ বোঝার আগেই তিনি হাওয়ায় দুহাতভাসিয়ে দিলেন ।

টাওয়ারগুলো তাই ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে , সামুদ্রিক বর্ষার প্রচণ্ড ঝড়েজলেও ।

এরকমইএকটা টাওয়ারে গিয়েছিলুম । এইসব টাওয়ারে সিকিউরিটির কড়াকড়ি থাকে । গেটে সিসিটিভিতে মুখ দেখালে যাঁর ফ্ল্যাটে যাবো তিনি মুখখানা দেখে অনুমতি দিলেযাওয়া যাবে । নয়তো গেটে দাঁড়িয়ে ইনটারকমে কথা বলে কাজ সারো । টাওয়ারগুলোরলিফ্টও দু’রকমের । ফাস্ট আর স্লো । বেশি ওপরে যারা থাকে তারা ফাস্ট ধরে উঠেযায়, সময়ও কম লাগে , কেননা তাদের গতিও তীব্র । যত বৈভবশালী তত ওপরে ।প্রতি ঘনইনচ দাম বাড়তে থাকে ওপরের ফ্ল্যাটগুলোর ।

আমি যাঁর ফ্ল্যাটে যাবো তিনি এই টাওয়ার সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ; ফলে আরওকড়াকড়ি । কিন্তু গেটে দেখলুম পুলিস দাঁড়িয়ে । টাওয়ারেও চুরি ? এত সিকিউরিটিসিসিটিভি ইত্যাদি সত্বেও ? হতে পারে, ভাবলুম । আজকাল চোরেরা কোন কোনফ্ল্যাটে দুপুর গৃহবধু বা বুড়ো বা বুড়ি একা থাকে তার খবরটবর নিয়ে হানা দেয়, কুরিয়ারের লোক বা প্লামবার বা কার্পেন্টার ইত্যাদির চেহারায় । বেশ কিছুমানুষ, যারা একা ছিল, খুন হয়েছে সম্প্রতি ।

কিন্তু পুলিশগুলোকে দেখে মনে হল না যে কেউ খুন হয়েছে , যদিও পুলিশের মুখপ্রায় গোমড়াই থাকে সবসময় । বাড়িতে গিয়ে গোমড়ানো মুখোশটা খুলে তারপর হয়তবউ-বাচ্চার সঙ্গে গল্পগুজব করে । কিন্তু খুন হয়ে থাকলে এমনভাবে নিজেদেরজিপগাড়িটা গেটের কাছে দাঁড় করিয়ে গুলতানি করত না । দু’জন কন্সটেবলকে তোদেখে মনে হল মুচকি হাসির আভাস রয়েছে । মুচকি হাসি দেখে এটা অন্তত বুঝলুমযে, যাক, কেউ তাহলে ওপর থেকে লাফ মারেনি । কিংবা খুন হয়নি কেউ । যাঁর ফ্ল্যাটে আমি যাব তিনি একদা হিন্দি অফিসার ছিলেন । হিন্দি অফিসারদেরমতন আরামের চাকরি আর হয় না । ইংরেজিতে লেখা চিঠি এলে, যে ভাষায় ছাড়া এখনওকেন্দ্রীয় সরকারে কাজ চলে না, ওনারা অনুবাদ করে দেন । সে অনুবাদ কেউ পড়ে না।তারপর উত্তরটা ইংরেজিতে তৈরি হয়ে গেলে ওনারা তার অনুবাদ করে দেন । দুটোচিঠি একই সঙ্গে প্রাপকের কাছে যায় । এবার প্রাপকের ইচ্ছে সে কোন ভাষায়উত্তর দেবে । অহিন্দি রাজ্য হলে অনেক অফিসার সেই রাজ্যের ভাষায় চিঠির উত্তরপাঠিয়ে দেন । তারপর তাগাদা পেয়ে আবার ইংরেজিতে-হিন্দিতে উত্তর দেন । কেননাএরও ডাটা রাখতে হয় হিন্দি অফিসারদের । তাঁদের কাজ ডাটা বাড়াতে থাকা ।ব্যাস । যত ডাটা বাড়ে তত অফিসারের সংখ্যা বাড়ে । কেন্দ্রীয় সরকারিঅফিসগুলোয় কয়েকটা হিন্দি সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিন নেয়া বাধ্যতামূলক । ফলেহিন্দি অফিসাররা সারাদিন টাইমপাস করার মতো খোরাক পেয়ে যান । সারা ভারতেহিন্দি পত্র-পত্রিকার বিক্রি সেকারণে অস্বাভাবিক । আমার তো মনে হয় অন্যান্যভাষাভাষীদের দাবি করা উচিত যে যত টাকা হিন্দি পত্র-পত্রিকা কিনতেসরকারিভাবে খরচ করা হচ্ছে তত টাকা অন্যান্য ভাষার পত্রিকাদের ভরতুকি হিসাবেদেয়া হোক । হিন্দি পত্র-পত্রিকার অমন বিপুল বাজারের দরুন তাদের লেখকরাওভাল আয় করেন । যাহোক, আমি মুখ দেখিয়ে কথা বলে পৌঁছোলুম হিন্দি অফিসারে ফ্ল্যাটে । আমি ওনার কাছে এসেছিলুম আমার একটা কবিতার অনুবাদের ব্যাপারে । প্রাথমিক অনুবাদকরে দিয়েছিলেন একজন উঠতি হিন্দি কবি, যিনি বাংলা জানেন না । এই হিন্দিঅফিসার বহুকাল কলকাতায় ছিলেন বলে বাংলা শব্দ কীভাবে খেলানো হয় তার আইডিয়াআছে । 

কিন্তু সে কাজটি আর করানো গেল না । অফিসার দরোজা খুলে দিতে দেখলুম তাঁরস্ত্রী একরকম , কী বলব, হ্যাঁ, ধূর্তই বলে, ধূর্ত হাসি হেসে ভেতরে চলেগেলেন । আমি বললুম, পুলিস এসেছে দেখলুম, গেটের কাছে জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে, কয়েকজন কন্সটেবল গুলতানি করছে ? হিন্দি অফিসার এবার প্রায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন । ভেতরের ঘর থেকে ওনারস্ত্রীও যে একা-একা হাসছেন আর তা সামলাতে পারছেন না টের পেলুম । গেটের কাছেপুলিস আর এনারা এরকম বেআক্কেলে হাসি হাসছেন । ওনার হাসির কারণ শুনে আমার অনুবাদের খসড়াটা পকেটেই থেকে গেল ।

উনি বললেন, তেইশ তলার ফ্ল্যাটে একজন মডেল থাকেন, জানেন তো, আরেকজন টুটারাশিয়ানের সঙ্গে ? টুটা রাশিয়ান মানে সাবেক সোভিয়েট রিপাবলিকের কোনোঅঙ্গরাজ্য । এই সমস্ত অঙ্গরাজ্যের যুবতীরা বা টুটা রাশিয়ান মেয়েরা বেরিয়েপড়েছেন সারা পৃথিবীতে রোজগারের ধান্দায় , নিজেদের দেশে, সোভিয়েট রিপাবলিকভেঙে যাবার পর খাবার জোটানো কঠিন হয়ে গেছে । বহু যুবতী, স্হানীয় ভাষা বলতেনা পারলেও, রোজগেরে যুবক পেলে বিয়ে করে থেকে যাচ্ছেন।

আমি বললুম, জানি, ওনাকে প্রায়ই দেখি রুপোলি স্যানট্রোতে আমাদের সামনেররাস্তা দিয়ে যেতে ; কখনও-কখনও টুটা রাশিয়ান মেয়েটিও থাকে সঙ্গে । তবে ওনারাকোন তলায় থাকেন তা জানি না । 

হিন্দি অফিসার বললেন, মডেল তো রোজ আটটারসময় বেরিয়ে যান ফেরেন অনেক রাতে । ওনার টুটা রাশিয়ান বন্ধু আবার ফেরেনও না ; দু’চার দিন কোথাও কাটিয়ে ফেরেন । আজ ওনার ফ্ল্যাট থেকে এমন আওয়াজ আসছিল যেওনার প্রতিবেশি এসে বললেন যে মডেল তো চলে গেছেন সকালে কিন্তু নিশ্চই চোরঢুকেছে , করাত দিয়ে বা কোনো কিছু দিয়ে কাটার আওয়াজ আসছে । আমিপ্রেসিডেন্ট ; তাই অনেকে নিজের ডুপলিকেট চাবি আমায় দিয়ে রেখেছেন, অরিজিনালটা হারিয়ে গেলে বা ভেতরে লক হয়ে গেলে আমার কাছ থেকে ডুপলিকেট নিয়েগিয়ে খোলেন । 

আমি তক্ষুনি গেলাম তেইশ তলায় । গিয়ে আমিও শুনে আন্দাজ করলাম যে চোরই ঢুকেথাকবে আর সে ব্যাটা কোনোকিছু কাটার চেষ্টা করছে । চোরটাকে ধরতে হবে ; পুলিসে ফোন করে দিলুম । পুলিস যখন এলো তখনও চোরটা কেটেই চলেছে , তাওদিনদুপুরে ।

পুলিসের সামনে ডুপলিকেট চাবি দিয়ে দরোজা খুললাম। আওয়াজটা তবুও আসছিল, ওনারবেডরুম থেকে । বেডরুমে গিয়ে দেখি কি চোর নয় , মডেল মেমসাহেবার ব্যাটারিঅপারেটেড ভাইব্রেটার ম্যালফাংশান করে আপনা থেকেই ভাইব্রেট করছে । একাথাকেন, বয়ফ্রেন্ড নেই, আজকাল যুবতীরা বেশ সতর্ক হয়ে গেছেন , তাইভাইব্রেটার দিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে প্রেম করেন । এটা তো নিজেকে ভালোবাসারস্বর্ণযুগ ; শীলাকি জওয়ানি গানটা শুনেছেন তো ?

নিজের সঙ্গে নিজে প্রেম !

ওটা কোথায় ? জানতে চাইলুম, পুলিস কি নিয়ে গেছে ? ডিলডো নামের বস্তুটিদেখেছি , নানা রঙের, মাপের, আকারের । অটোমেটিক ব্যাটারি চালিত ভাইব্রেটারদেখা হয়ে ওঠেনি ।

হিন্দি অফিসার ড্রইংরুম সংলগ্ন বাথরুমে গেলেন , তোয়ালে দিয়ে ধরে একটি গোলাপি রঙের জিনিস নিয়ে এলেন । বললেন, দেখে তো মনেহচ্ছে রাতে ইউজ করা, তাই তোয়ালে দিয়ে ধরে আছি ।

গোলাপি ! রঙের চয়েসটাও প্রসংশনীয় ।

ভাইব্রেটার যা ঘটায় তা হল অরগ্যাজম ।অকুস্হলে পরিয়ে বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে পড়ো , মৃদু কোনো সুর বাজতে থাকুকপ্রায়ান্ধকার বেডরুমে । ভাইব্রেটার তার কবিত্বের কাজ চালিয়ে যাবে তৃপ্তি নাপাওয়া পর্যন্ত । তৃপ্তির চরমে পোঁছোলে বস্তুটির সুইচ অফ করে গভীর ঘুমেএলিয়ে পড়ো । পুরুষ সামলাবার হ্যাপা নেই । পুরুষের অসফল, অর্ধসফল, সময়েরপূর্বেই ফুরিয়ে ফেলার অতৃপ্তি নেই ।

নেমে এলুম টাওয়ারের ফাস্ট লিফ্ট বেয়ে । তাহলে কেবল মৃত্যু নয়, টাওয়ারগুলো প্রেম-ভালোবাসাকেও আত্মস্হ করতে শিখে ফেলেছে ।

আগে দেখিনি । গেটের বাইরে দেখলুম গ্র্যানাইটে সোনালি অক্ষরে টাওয়ারটার নাম লেখা: ‘স্মাইলিং লিপস অ্যাপার্টমেন্টস’ ।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

মলয় রায়চৌধুরীর ঝুরোগল্প : গাধার জেব্রার রূপ ধারণ

সকালবেলার তন্দ্রাচ্ছন্ন গোরস্তানে, কালো হোসপাইপ-লিঙ্গ ঝুলিয়ে-দুলিয়ে দৌড়োচ্ছিল গাধাটা । এখনকার পেণ্ডুলাম । যেন সময়ের কন্ঠস্বর । সুযোগ পেলে হড়হড় করে ঝরবে বিদ্রুপ । কান নাচিয়ে দৌড়।গাধাটার ডাকে এমন তীব্র স্বরাঘাত ছিল যে মনে হচ্ছিল পুরো সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা’র ভাঙা আয়নার টুকরো-টাকরা দিয়ে সাজানো । আতঙ্কের বিস্ফোরণে গাধাটা, যার অভ্যাস শুধু ধোপার ধাতানি খাওয়া, সমবেত লোকগুলোকে এড়িয়ে দৌড়চ্ছিল , ছায়ায় গলতে থাকা একটা আকৃতি, যার ফাঁপা ডাকের মোড়ক ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে সূর্যের আলো, উত্তেজনার অবরোহণের আদল-আদরায় ।

গাধার গায়ে, একদিকে, আরবি বা ফারসি বা উর্দুতে কিছু লেখা, আলকলাতরা দিয়ে । বারান্দা থেকে গরিব লোকেদের মারামারি দেখে আঁচ করলুম ব্যাপারটা হিন্দু-মুসলমানের নয়, কেননা গাধাটার গায়ে উর্দু, বা ফারসি কিংবা আরবি হরফে আলকাৎরা দিয়ে কয়েকটা শব্দ লেখা  । আব্রাহামিক বিশ্বাসের মানুষেরা লিখে রাখা অক্ষরকে ভয় পায়, ক্যাথলিক স্কুলে পড়ার সময়ে টের পেয়েছিলুম । 

জাল-বসানো ঘন নীল ভ্যান থেকে নেমেই  জন-পনেরো পুলিশ  তাড়া করে ধরতে লাগলো ধুলোটেলাঠি  আর জংধরা তরোয়ালধারী লোকগুলোকে, যারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল । তরোয়াল উঁচিয়ে গাধাটার দিকে দৌড়োচ্ছিল লুঙ্গিপরা রোগাটে একজন দাড়িয়াল প্রৌঢ়, যার লুঙ্গিতে পুলিশের টান পড়তেই উলঙ্গ হয়ে সে তরোয়াল ফেলে দিয়ে অসাড় আতঙ্কের গ্রাসে পড়ে দু’হাত দিয়ে নিজের লিঙ্গের নগ্নতা সামলানো জরুরি মনে করলো । কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে লুঙ্গিটা  পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো কনসটেবল । ল্যাংটো অবস্হাতেই, ঢুকতে না চাইলেও,  পুলিশ তাকে ভ্যানে ঢোকালো, লোকটার পোঁদে সূর্যের আলো পড়ে তামার খাদ মেশানো সোনার মতন ঝিলিক মারছিল, যেন লোকটার দুঃখের জানালার সামান্য ফাটল থেকে ছড়িয়ে-পড়া আলো । অনেক সময়ে সেই সব মানুষের পোঁদও তাদের অভিব্যক্তির  আয়না হয়ে ওঠে, যাদের মাতৃভাষা হলো টাকাকড়ির খাঁকতি, অন্নের অভাব । কোনো ভয় খিদের সামনে টিকতে  পারে না, কোনো ধৈর্য তা শেষ করতে পারে না, যখন খিদে আর সামলানো যায় না তখন ঘৃণাও কাজে লাগে না, আর একজন লোকের খিদের সামনে কুসংস্কার, বিশ্বাস আর নীতি স্রেফ অস্তিত্বহীন । নগ্নতার কথা আলাদা, সম্ভবত ।

বন্দুকের কুঁদো আর লাঠির মার দিয়ে পুলিশ  যে কজনকে পাকড়াও করতে পারলো,  নিয়ে গিয়ে ঢোকালো ভ্যানে। একজন কনসটেবল গাধাটার কান দুটো ধরে, আরেকজন  পেছনে লাথি মেরে-মেরে ঢোকালো  । পুলিশকে অবজ্ঞা করে, গাধাটাই শুধু ঢুকতে আপত্তি করল না, বিশাল কালো লিঙ্গ ঝুলিয়ে আর দুলিয়ে ভ্যানের ভেতরে চলে গেল ! গাধার ডাক থামতেই ভারি আর আরামদায়ক স্তব্ধতায় ছেয়ে গেল কয়েকশো বছরের পুরোনো গোরস্তানের খণ্ডহর। 

পাড়ার ধোপা গাধাটাকে যখন থানা থেকে ফেরত আনলো, দেখলুম যে উর্দু বা আরবি বা ফারসি লেখার ওপরে আলকাতরা বুলিয়ে তাকে জেব্রা করে ফেলা হয়েছে, মারামারি থামাবার জন্য ।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

মলয় রায়চৌধুরীর গল্প : শৈশবের ভোজপুরি গানে নোংরামির আনন্দ

শৈশবের ভোজপুরি গান

শৈশবের ভোজপুরি গানে নোংরামির আনন্দ  : 

আমার ছোটোবেলার  ইমলিতলা ছিল পাটনা শহরের গরিব অন্ত্যজদের, যাদের এখন মহাদলিত বলা হয়, তাদের বস্তি ।   আমার চরিত্রগঠনে বা বিগঠনে খাঁটি অবদান  ইমলিতলার মানুষগুলো  ; সেখানকার অভিজ্ঞতা আমাকে শিক্ষিত করে তুলেছে, শিখিয়েছে মানসিক-ঔদার্য, সারগ্রাহীতা, তার প্রতিটি বাসিন্দা ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী, বেপরোয়া, গোলমালকারী, স্হিতাবস্হাবিরোধী, যারা নিজেদের বলতো “দুনিয়াকা নাসুর”, মানে পৃথিবীর এমন নালি-ঘা, যা সারে না । প্রথমে বিদেশি ও পরে স্বদেশি সরকার তাদের জীবনযাত্রার লড়াইকে মনে করেছে প্রতিরোধ-প্রতিবাদ, মনে করেছে মৌরসি-পাট্টার শত্রু, তাদের মনে করেছে বিপজ্জনক, অথচ তা ছিল ওদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা । জীবনকেচ্ছা প্রায় প্রতিদিনই ঘটতো ইমলিতলা পাড়ায় কিন্তু সেসব নিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের মতন কেউই খিক-খিকে হাসি হাসতো না, মাথা ঘামাতো না । যে কোনো উৎসবে ভোজপুরি বা পাটনাই গান গাইতো পাড়ার বউ-ঝি-মরদরা মিলে, ঢাক-ঢোলোক পিটে, যেমন এই গানটা :

যৌবন হোই ফিউজ জে করবে তু ইউজ
হই চঢ়ল তোর জওয়ানি ছোড়তা কোই পানি
এ রানি
যৌবন হোই ফিউজ জে করবে তু ইউজ
হই চঢ়ল তোর জওয়ানি ছোড়তা কোই পানি

ইমলিতলা পাড়ায় কবিতা নামে কোনো ব্যাপার ছিল না । ছিল ভোজপুরি বা পাটনাই গান, যাকে কেবল পাড়ার লোকেরা নয়, আমাদের বাড়িতেও অশোভন বা অশ্লীল মনে করা হতো না । আমার মা ওই পাড়ার বুলি রপ্ত করে ফেলেছিলেন, যা, উনি পরে জানতে পারেন, সংস্কৃতিবান হিন্দিভাষীদের কাছে অশোভন, এমনকী অশ্লীল । ইমলিতলার বস্তিবাসীদের জমায়েতে ইঁদুর পুড়িয়ে খাওয়া হতো, শুয়োরের মাংস খাওয়া হতো ; শৈশবে আমি পুরো ইঁদুর-পোড়া  খাইনি, বমি করে ফেলব আঁচ করে, তবু একটুকরো মুখে দিয়ে চেখেছিলুম, বিটকেল সোঁদা গন্ধ ; তবে শুয়োরের মাংস যখনই পাড়ায় রাঁধা হতো, খেয়েছি । দাদা সমীর রায়চৌধুরী ইঁদুর-পোড়া খেয়েছিল, তাড়ি দিয়ে । আমার তাড়ি আর ঠররা খাবার ট্রেনিঙ তো ইমলিতলায় । তাড়ি খেয়ে এরকম গান গাওয়া হয় :

তোহরা ইসক মেঁ পাগল
ভইল কাচি কাওয়ারি
ভইনি হম জয়সে
গরমি কে শাম সজনা
হাঁ বে তু লওঙ ম্যাঁয় ইলাইচি
হাঁ বে তু লওঙ ম্যাঁয় লাআআচি
তেরে পিছে আ গওয়াচি
তু লওঙ ম্যাঁয় ইলাইচি

অনেকের মতে, গত এক দশক ধরে ভোজপুরি ভাষায় লেখা গানের মিউজিক ভিডিওতে এমন ধরনের দৃশ্য দেখানো শুরু হয়েছে যাকে অনেকেই সফট পর্ন বলেন । অন্য পাড়ায় যে বাঙালিরা থাকতেন তাঁরা ভোজপুরি বা পাটনাই গানগুলোকে মনে করতেন নোংরা ।   আমি আমার সহ্যশক্তি আর যুঝে যাবার ক্ষমতা ইমলিতলার বস্তি থেকেই পেয়েছি : হাতকড়া, কোমরে দড়ি, জেলহাজত, শত্রুদল, কুখ্যাতি, অপমান, অপপ্রচার, বিরোধিতা, কটূ মন্তব্য, বিশ্বাসঘাতকতা । সেই পাড়ার গান শুনলে টের পাওয়া যায় যে অমন বস্তিতে জীবনের শুরুটা কাটিয়ে বাংলা সাহিত্যে ঢোকাকে বলা যায় জীবনের টেকটনিক প্লেটে শিফট ।

কেমন গান ? যা শুনলে মগজের সহ্যশক্তি বাড়ে ? এরকম :
দায়ে অওর বায়ে কে হিলে ত লাগে বেটর
দায়ে অওর বায়ে কে হিলে ত লাগে বেটর
হই তোত দুনু ইনডিকেটর
হই তোত দুনু ইনডিকেটর 

ইমলিতলাতেই জেনেছি, প্রতিটি নারীর দেহে নিজস্ব সুগন্ধ থাকে যা শহুরে মহিলারা পারফিউম মেখে নষ্ট করে ফ্যালে , পারফিউম জিনিসটা তাই আমার পছন্দও নয় , পাড়ার সকলের বাসার মতনই আমাদের বাড়িতেও কলিং বেল ছিল না, বাড়ির কারোর সঙ্গে দেখা করতে হলে বাইরে থেকে তার নাম ধরে ডাকতে হতো । নাম ধরে ডাকার এই বাচনিক সম্পর্ক হারিয়ে গেল ইমলিতলা ছাড়ার পর। আমাদের বাড়িতে ইমলিতলার দিনগুলো নিজস্ব রঙে আর গন্ধে দেখা দিতো, রাতগুলো দেখা দিতো কেরোসিন লন্ঠন আর রেড়ির তেলের লম্ফর শিখায় । সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে লন্ঠন জ্বালানো হলে বাইরে থেকে ভেসে আসতো তাড়ি-টানা পাড়ার বাসিন্দাদের সমবেত গান :

সবকে এহি রংগ ডর বাডু রে সবকে জোরি মেঁ হথিয়ার বাডু রে
নহি নাচ বুত পলট জায়েগা সামান তোহরা ফট জায়গা
হোঠওয়া কী লালী চুসা হো নাক কে নথিয়া খুলাই হো
হনা তনি করবু তো রানি হো গোলি চলগে ছেদড়ি হো
সামান তোহরা ফট জায়েগা
হামি তা অব জওয়ান হোই নহি কে দে অব তেরতার হো
অরে নহি তো পিলান তোহরা কট জায়েগা
সামান তোহরা ফট জায়েগা

সংবাদে পড়লুম, ভোজপুরি সিনেমা জগত থেকেই পরিচিতি অথচ সেই দুনিয়ার গান নিয়েই অভিযোগ তুলেছেন অভিনেতা তথা বিজেপি সাংসদ রবি কিষাণ। তাঁর অভিযোগ, “চূড়ান্ত অশ্লীলতা চলছে ভোজপুরি গানে। তাই এই নোংরামো বন্ধ করতে কড়া আইন দরকার। এই বিষয়ে রবি কিষাণ  সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “ভোজপুরি ভাষা শতাব্দী প্রাচীন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভোজপুরি গানে যে সব শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে তা কখনওই মেনে নেওয়া যায় না।  শুধু গানের লিরিকস নয়, তার উপস্থাপনও হচ্ছে অশ্লীল ভাবে।” রবি কিষাণ অমন কথা বলেছেন কেননা ভোজপুরি সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক হলেন নিরাহুয়া, যিনি বিজেপি টিকিটে উত্তরপ্রদেশের আজমগড় থেকে লোকসভা নির্বাচন জিতেছেন আর নায়িকাদের জড়িয়ে যে ধরণের অভিনয় করেন তা অন্য ভোজপুরি অভিনেতারা পারেন না ।

যেকোনো লোকগানের মতন ভোজপুরি গানও ছিল নিম্নবর্ণ-নিম্নবর্গের সাংস্কৃতিক আস্ফালনের পরিসর। রবি কিষাণ ব্রাহ্মণ কিন্তু নিরাহুয়া নিম্নবর্ণের । নিরাহুয়ার জনপ্রিয়তার কারণও সমাজের এই বর্গে ভোজপুরি গানের আকর্ষণ, যাঁদের কাছে, গানগুলো, ইমলিতলা পাড়ার মতনই, নোংরা বা অশ্লীল বলে মনে করা হয় না । বাংলায় যে নামকরা কবিয়ালরা ছিলেন, তাঁরাও ছিলেন নিম্নবর্ণের, যেমন গোঁজলা গুঁই, নিত্যানন্দ বৈরাগী, ভবানী বেনে, রঘুনাথ দাস,  ভোলা ময়রা, কেষ্টা মুচি, যজ্ঞেশ্বর দাস, নীলমণি পাটনি, শ্যামসুন্দর স্যাকরা, জগন্নাথ বেনে, মতি পসারি, ভীমদাস মালাকার, জগা কৈবর্ত্য প্রমুখ । ভোজপুরি গান টিকে গেল কারণ ম্যাকলের শিক্ষাপদ্ধতির ছক ব্রিটিশ আমলে ভোজপুরি বলিয়ে-কইয়েদের ভৌগলিক এলাকায় তখন পৌঁছোয়নি ।

রবি কিষাণ যে ধরণের ভোজপুরি গানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন , তা আমি শৈশব থেকেই শুনে আসছি । এখন সেগুলো অভিনয় করে দেখানো হচ্ছে বলে, যাঁরা সমাজের ওপরতলায় চলে গেছেন, তাঁদের নোংরা মনে হচ্ছে। বাংলা ভাষার ডহরওয়া, পতরতুলা ,বেঁগাড়ি ,ঝুমরা, ঝুমটা, নাগপুরিয়া ,তামাড়িয়া, পাঁচপরগনিয়া ,মুদিআরি ইত্যাদি ঝুমুর গান আর কবিয়াল তথা দাঁড়াকবিদের যদি ভদ্রলোক ব্রাহ্মরা আর খ্রিস্টান পাদ্রি-শিক্ষকরা ‘নোংরা’ ছাপ্পা মেরে বিদেয় না করতেন, তাহলে এখনকার ভোজপুরি গানের মতন আমরা ভিন্ন ধরণের বাংলা গানের সঙ্গে পরিচিত হতুম ; তার লিরিক্স হতো আলাদা  । বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কৃত্তিবাস’, সুশীল রায়ের ‘ধ্রুপদী’, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’, অরুণকুমার সরকারের ‘উত্তরাধিকার’ ইত্যাদি কবিতার পত্রিকায় আমরা কবিয়াল, দাঁড়াকবি, ঝুমুর গায়কদের মতন নিম্নবর্ণের নাম দেখতে পাই না । হাংরি আন্দোলনের কবি হারাধন ধাড়ার কবিতা স্বীকৃতি পাচ্ছিল না বলে তিনি এফিডেভিট করে নিজের নাম দেবী রায়তে পালটে ফেলেছিলেন ।

ভোজপুরি সিনেমা জগতের সুপারস্টার  নিরাহুয়ার সিনেমা বা ভিডিও ইউটিউবে আসামাত্রই একেবারে জনপ্রিয়তার টঙে পৌঁছে যায় সেই দিনই। শুধুমাত্র তাঁর নতুন গান নয়, তাঁর একাধিক পুরনো গানও সোশ্যাল মিডিয়াতে অত্যন্ত জনপ্রিয় । তিনি ভোজপুরি সিনেমা জগতের এমন একজন তারকা যার নামেই সিনেমা সুপারহিট হয়ে যায়। তার মত তারকা ভোজপুরি সিনেমার জন্য বেশ লাভের ব্যাপার কারণ তার জনপ্রিয়তার উপরে ভর করেই ভোজপুরি সিনেমা অন্য মাত্রায় পৌঁছেছে। তিনি ইতিমধ্যেই এমন কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন, যে সমস্ত ছবি ভোজপুরি এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মত রাজ্যে নিরাহুয়ার ছবি  মানেই সুপারহিট। তার সঙ্গে আম্রপালি দুবের যৌন রসায়ন যে-কোনো ভোজপুরি সিনেমায় দর্শকদের জন্য ফাঁদ পেতে রাখে। এই রোম্যান্টিক জুটির ফিল্ম তালিকায় এমন কোনো সিনেমা নেই যা ফ্লপ হয়েছে।

সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা-পদ্ধতির হস্তক্ষেপে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায়  বাংলা ভাষার ডহরওয়া, পতরতুলা ,বেঁগাড়ি ,ঝুমরা, ঝুমটা, নাগপুরিয়া ,তামাড়িয়া, পাঁচপরগনিয়া ,মুদিআরি ইত্যাদি ঝুমুর গান আর কবিয়াল আর দাঁড়াকবিদের বিশেষ আলাপচারিতা । শুধু তাই নয় । তারপর থেকে কর্ম ও জ্ঞানের স্হায়ী বিভাজন ঘটে যায় । আজকে আমরা চিন্তাই করতে পারি না যে একজন মুচি জুতো সেলাই করছেন, তাঁতি তাঁত বুনছেন, স্যাকরা গয়না গড়ছেন, মাঝি নৌকা বাইছেন, জেলে মাছ ধরছেন আর সেই সঙ্গে কবিতা লিখছেন আর খ্যাতি পাচ্ছেন । এনারা শ্রম বিক্রি করতেন কিন্তু আধুনিক কবিরা কবিতা বিক্রি করেন ।

প্রখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা গোবিন্দদাসের মাতামহ দামোদর সেনের ‘সঙ্গীত দামোদর’ গ্রন্থে প্রথম ‘ঝুমুর’ শব্দ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত সঙ্গীত দামোদরে উল্লেখ আছে- “প্রায়ঃ শৃঙ্গারবহুলা মধ্বীক মধুরামৃদু।/একৈব ঝুমুরীলৌকে বর্ণদিনিয়মোজ্‌ঝিতা” [প্রায়সই শৃঙ্গারবহুল মধুর মৃদু সুরার (মাধ্বীক) মতো। ঝুমুরে বর্ণাদি (বর্ণালঙ্কার ও ছন্দ) নিবদ্ধ নয়।] ঝুমুর সম্পর্কে সঙ্গীত দামোদর-এর এই উক্তি অনুসারে জানা যায়, ঝুমুর গান শৃঙ্গার রসের এবং তাতে মধুর ব্যঞ্জনা আছে। অশ্লীল বলে এই গান দোষণীয় নয়। এই গানের কোনো বাঁধা-ধরা ছন্দ ছিল না।

বিশিষ্ট ঝুমুর কবি ও গবেষক সুনীল মাহাত এক সাক্ষাৎকারে  ঝুমুর গান নিয়ে  আলাপচারিতায় সোহম দাসকে বলেছেন, “ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন রাজন্যভাতার বিলোপ হল, তখন ঝুমুরকে মদত দেওয়ার আর কেউ থাকল না। ঝুমুরের শ্রোতা হল সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুযায়ী অনেক গান রচিত হল এবং সেগুলো কিছু নিচুস্তরের যৌন-উত্তেজক  গান  হল। ঝুমুরকে সেই সময়টায় বলা হতে লাগল, ‘মাতালদের গান’। বলা হল, যারা মুনিশ, কামিন, বাগাল, মানে যারা শিক্ষিত লোক নয়, এটা তাদের গান। সেই সময়টাতে ঝুমুর ভীষণ নিন্দিত হতে থাকল। যারা শিক্ষিত সম্প্রদায়, তারা ঝুমুর সম্পর্কে বলত যে, না, না, ওইসব গান চলবে না। কলকাতারও কিছু পণ্ডিত-শিল্পী ঝুমুরকে ‘যৌনগন্ধী’ গান বলে আখ্যায়িত করল। এটা ঠিক ভদ্র সমাজে চলে না, এরকম একটা গান। আমরা যখন ঝুমুর নিয়ে চর্চা শুরু করলাম, তখন কিন্তু বাড়ির লোকরা আমাদের বাধা দিত। বাবা এসে বলতেন যে, না, না, বাড়িতে এসব ঝুমুর গান নয়, ওসব বাইরে।”

অর্থাৎ, আদি ঝুমুর গান বিলুপ্ত হয়ে গেল এবং তার জায়গায় দেখা দিল ভদ্রলোকদের ড্রইঙরুমে চলতে পারে এমন সব লিরিক্স, যাকে প্রকৃত ঝুমুর গান বলা যায় না । আদি ঝুমুর পর্বে শিল্পী ও শ্রোতারা ছিলেন প্রান্তিক অর্থাৎ নিম্নবর্গের শ্রমজীবী মানুষ। ধর্ম ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এরা ছিলেন অন্ত্যজ। এই সময়ে স্থানীয় কূর্মি, মাহাতো, কুমোর, রাজওয়ার, ঘাটাল, হাড়ি, মুচি প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল ঝুমুর। একই সময় ঝুমুর গান করতেন সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা ইত্যাদি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। আদি ঝুমুর ছিল এইরকম :

দেখ্যে বাড়ালি তকে
তুঁই না দিলি হামাকে
বুকের মাঝে শিমল কঁড়ি দলকে
সেই দেখে মন ললকে।
[তোকে দেখে বড় হয়েছি। তুই সঙ্গম করতে দিলি না। বুকে তোর শিমুলফুলের মত স্তন দেখে, মন উত্তেজিত হয়েছে]

সুনীল মাহাত আরও বলেছেন, “আগে আমরা যে ঝুমুরগুলো শুনতাম, গ্রামের মাঠে-ঘাটে, সেগুলো ঠিক পরিশীলিত বলা যায় না। এমনিতে মাঠে-ঘাটে যারা গানটা ন্যাচারালি গায়, তারা তো প্রফেশনাল গায়ক-গায়িকা নয়। তাদের গাওয়া গানগুলো ঠিক কানে লাগার মতো ছিল না।   গ্রামে  কিছু ঝুমুর নাচের দল ছিল। কম ছিল, কিন্তু ছিল।  তখন কিছু কিছু নাচনি নাচের শো হতো। নাচনিরা নাচত বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে। দেখলাম যে, তার মধ্যে ঝুমুরের অনেক ভ্যারাইটি আছে। ধীরে ধীরে যখন আমি ঝুমুরের মধ্যে প্রবেশ করছি, তখন আমি দেখছি, যে, প্রাচীনকালে এক ধরনের ঝুমুর ছিল।”

যেমন : “আমার বঁধু রাতকানা /বাড়ি দিগে আনাগোনা/দেখ বঁধু গবর গাড়ায় ঢুকনা/আমাকে সাঁতায় না।/ঝাঁড়গাঁর হাট যাতে যাতে/বিহায়ে ধরিল হাতে/বিহাই ছাড়ো হাত/  ঝুড়ি ঝাঁটি বিকেই সাঁঝের ভাত।”
অথবা : “ভাত খাবি না মদ খাবি/হাটে যাবি না ঘরে যাবি।/বলি তোর দামটা ফুটা কড়ি তুই/আরে তোর দামটা ফুটা কড়ি তুই,/কোথা যাবি বিগাইতে।/লে লে ঝুমুর গাইলে তুই,/বোল তুলে দে মাদলে। আছিসে লগন এবার,লে লে পরব লাগায় দে।/কমলির যৌবন পুরালো,/অরে গ্যাদার মালা শুকালো রে…।/ লাল ফিতা কাঁচের চুড়ি,/মাথার কাটা, কলের ঝাড়ি।/রথের মেলায় কত লগন/দেখলি ঘুমের ঘরেতে।/ছাড় না ক্যানে খ্যামটা নাচোন,/ও তোর হ্যেড়িয়া মনের গ্যাছে লগন।আইলো যে ঝড়, কাজন মেলা,/ঝড় কদমে, বাধন জ্বালা। /সবাই মিলে মাররে ঠ্যেলা,/পাহাড় টকে সওরাইতে।/লে লে পরব লাগায় দে।”

ইউরোপের ঔপনিবেশিক ভাবুকরা ঠেকে শিখেছিলেন, যে, বলপ্রয়োগ করে নয়, উপনিবেশকে কব্জায় রাখতে গেলে, নিজেদের সিংহাসনটি বসাতে হবে নেটিভের মগজে, যাতা সাম্রাজ্য গুটিয়ে ফেলার পরও ভাবজগতটির দখলিসত্ব বজায় রাখা যায় । ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রকে তাই ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হলো লোককবিদের সাথে-সাথে । গ্রামের যাত্রাভিনয়কে জেমস লঙ বলেছিলেন অশোভন ও ইতর, ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরকে বলেছিলেন নোংরা, পাঁচালিগুলোকে বলেছিলেন লালসা-উদ্রেককারী ও অশ্লীল, বেতাল পঞ্চবিংশতিকে বলেছিলেন মোটাদাগের ও অশালীন । জেমস লঙের আক্রমণে বটতলা সাহিত্য তো লোপাট হয়ে গেল ।

ইংরেজদের ভাবকাঠামোয় ছিল বিশেষ ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ : অনুসন্ধান, পরীক্ষা, উঁকি, সাক্ষাৎকার, নিরীক্ষণ, পরিদর্শন, তদন্ত, চরগিরি ইত্যাদি এবং বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন টেরি করা, যাতে উপনিবেশের লোকসংস্কৃতিটি ছারখার হয়ে যায়, স্মৃতি বিপর্যয় ঘটানো যায় । আমরা তাই দেখি যে জেলা গেজেটিয়ারগুলোতে ডাকাত আর ঠগিদের অনুপূঙ্খ খবর থাকলেও, প্রাগাধুনিক বাঙালি কবি, গায়ক, বাউল, এঁদের বিষয়ে তথ্য সেনসর করেছিল ব্রিটিশ শাসকরা । ইংরেজরা বিদায় হবার পর মসনদে বসেন ভদ্রলোকদের দল যাঁরা জগা কৈবর্ত্য, কেষ্টা মুচি, ভবানী বেণে, গোঁজলা গুঁইয়ের মাঝে নিজের বাপ-ঠাকুর্দাকে চিনতে পারেননি । ব্রিটিশ কর্তাদের সংস্কৃতিটি সবর্ণরা উৎকৃষ্ট মনে করে বজায় রাখলেন আর যাবতীয় দেশজকে দিলেন নিকৃষ্টের তকমা । এর কোনও স্বকীয় নান্দনিক যুক্তি নেই । ফলে মর্সিয়ার চেয়ে এলেজি হয়ে উঠল শ্রেয়, নৌরচকা ও ভাটিয়ালির চেয়ে লিরিক, লাউনি ও সারির চেয়ে ওড, সখিসংবাদের চেয়ে বেলেলেটার্স, মুর্শিদা ও নিকউবানার চেয়ে লিমেরিক, লেটোর গানের চেয়ে রক অ্যান্ড রোল ।

ইমলিতলার মসজিদে লাউডস্পিকার ছিল না ; রমজানের সময়ে একজন ফকির ভোর রাতে গান গাইতে-গাইতে যেতো যাতে পাড়ার মুসলমান পরিবারের সদস্যদের ঘুম ভেঙে যায় । সেই ফকিরের এক হাতে সাপের মতন ব্যাঁকা ছড়ি আর অন্য হাতে লাউয়ের মোটা খোসা শুকিয়ে তাতে লোবানের ধোঁয়া। মুসলমান পরিবারগুলো ছিল অত্যন্ত গরিব কিন্তু রোজা পালন করতো । তবু, পাড়ায় যখন ঢোল-ঢোলোক বাজিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পুরুষ আর মহিলারা এইরকম  ভোজপুরি গান আরম্ভ করত, কেউ বাধা দিতো না :

খিড়কি বন্দ কর দে দরওয়াজা বন্দ কর দে
বহিয়া মেঁ আগ বুঝবা নস নস মেঁ উঠে লহরিয়া
দিল বহর হো যায়ে না তনি প্যার হো যায়ে
বহিয়া মেঁ লেলে সাজন দহিয়া মেঁ উঠে লহরিয়া
হোটবা কে আস পাস হোটবা রহে দাস
অঁখিয়া সে প্যার ওয়ালি বতিয়া কহ দে
তনি মারজাই য়ে নজরিয়া নহি বাটে মেঁ উমরিয়া
সজিয়া সাজীই ছতরিয়া মেঁ আবা

উর্দু সাহিত্যে কবিয়ালরা আজও সমাদৃত কেননা মুসলমান সমাজ ব্রিটিশ মূল্যবোধকে প্রতিরোধ করে নিজেদের মুশায়রা লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে । দেশভাগের আগে পাঞ্জাবিরা উর্দুতে লিখতেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও বক্তব্যটা প্রযোজ্য । গুলজারের মতো বহু কবি আজও হিন্দি কবিতা উর্দুতে লেখেন । মুশায়রায় থাকে  এক জাদু, এক ধরনের নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠতা। একটি শায়রি, তার কবি এবং শ্রোতাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার আনন্দ, প্রতিফলন এবং আত্মীয়তার অনেক সম্ভাবনার জন্ম দেয়। আমাদের কবিয়াল, দাঁড়াকবি, তরজা, পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই,  বসা কবিগান, ঢপ, টপ্পা,  তুক্কাগীতি,  লেটো, আলকাপ, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, ভাওয়াইয়া,  আর্যা,  আর ঝুমুর গায়করা সেই আত্মীয়তাই গড়ে তুলতেন দর্শক আর শ্রোতাদের সঙ্গে । এখন এই গানগুলোর নবায়ন করছেন মূলত উচ্চবর্ণের গীতিকার-গায়ক ও গবেষকরা, যে কারণে প্রাচীনকালের জীবনপ্রবাহ, আঞ্চলিকতা, যৌনতা, স্হানিকতা, উদ্বেলিত-স্বর, বিরহের গ্রাম্য ভাবাবেগ,   গ্রামীণ নারীর প্রেমপ্রীতি, ভালবাসা, , আকুলতা, লৌকিক জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ইত্যাদি হয়ে যাচ্ছে এলিট সমাজের উপভোগ্য ।

রবীন্দ্রনাথ কবিগান সম্পর্কে বলেছেন “কথার কৌশল, অনুপ্রাসের ছটা এবং উপস্থিতমত জবাবেই সভা জমিয়া উঠে এবং বাহবা উচ্ছ্বসিত হইতে থাকে—তাহার উপরে আবার চার জোড়া ঢোল, চারখানা কাঁসি এবং সম্মিলিত কণ্ঠের প্রাণপণ চীৎকার—বিজনবিলসিনী সরস্বতী এমন সভায় অধিকক্ষণ টিঁকিতে পারেন না।এই নষ্টপরমায়ু ‘কবি’র দলের গান আমাদের সাহিত্য এবং সমাজের ইতিহাসের একটি অঙ্গ, এবং ইংরাজ-রাজ্যের অভ্যুদয়ে যে আধুনিক সাহিত্য রাজসভা ত্যাগ করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন যে তিনি উচ্চবর্ণে আর উচ্চবর্গে জন্মেছেন বলে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী প্রভাবিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, “ “আমি যদি পল্লী কৃষকের ঘরে জন্মাতাম, কিম্বা মাঝি, মালো, কর্মকার বা তন্তুবায়ের ঘরে, আর আমার যদি থাকত সহজাত কবিত্বশক্তি তাহলে আমি বড়জোর একটা কীর্তনের বা পাঁচালীর দল খুলতাম অথবা কবিয়ালরূপে গ্রামে গ্রামে গাওনা গেয়ে বেড়াতাম৷ সমাজের প্রতিকূল পরিবেশেই প্রতিহত হত আমার এর চেয়ে বেশী কিছু হওয়ার সম্ভাবনা৷ আমি জানি অনেক সম্ভাবনীয়তার কুঁড়িই এভাবে অকালে ঝরে যায় যেগুলি ফুল হতে পারে না এবং দেখেছিও তেমন দু’দশজন৷”

রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য অনেকটা রবি কিষাণের মতন । ইমলিতলার বস্তিতে শৈশব কাটালে তাঁর মতামত নিঃসন্দেহে আলাদা হতো ।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

মলয় রায়চৌধুরীর ছোটগল্প : আলুর দোষ

আলুর দোষ 

১৯৬৪ সালে ঠাকুমা ৯৪ বছর বয়সে মারা যাবার পর, আমাদের উত্তরপাড়ার বসতবাটী ‘সাবর্ণ ভিলা’ খন্ডহরে পরিণত হয়েছিল । কিন্তু কলকাতায় রাতে কোথাও আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না বলে ওই খন্ডহরেই রাতটা কাটাতে হতো । ঠাকুমা একা কী করে ওই বারো ঘরের বিশাল খন্ডহরে থাকতেন জানি না ; উনি পাটনায় আমাদের কাছেও যেতে চাইতেন না, বলতেন যে পাটনার বাড়িতে উনি হাঁপিয়ে ওঠেন ; গাছপালা নেই, খোলা আকাশ নেই, কুয়োতলা নেই, বাংলায় গল্প করার জন্য বুড়িদের জমায়েত নেই । 

ষাটের দশকে যখন আমার বিরুদ্ধে মামলা শুরু হল, আমি ওই খন্ডহরেই আদালত থেকে ফিরে যেতুম রাতটা কাটাবার জন্যে । ঠাকুমা থাকতে ওনার হবিষ্য খেয়ে চলে যেত । উনি মারা যাবার পর খাওয়াটা সমস্যা হয়ে দেখা দিল । সমস্যাটা আরও জটিল হয়ে উঠত কলকাতার বাইরে থেকে আমার বন্ধুবান্ধবরা আসলে । কলকাতায় তাঁদের আস্তানা নেই । 

অনেকে খন্ডহরটাই পছন্দ করত প্রধানত যা ইচ্ছা তাই করার বা ফোঁকার বা পান করার স্বাধীনতার জন্যে । ত্রিদিব মিত্রের বাড়ি ছিল হাওড়ার সালকিয়ায় ; তবু ও মাঝে-মধ্যে উত্তরপাড়ার খন্ডহরে থাকতে চলে আসত আমার সঙ্গে । ঠাকুমা মারা যাবার পর বাড়ির সিংদরজার পাল্লা দুটো আর দুটো পায়খানারই কপাট চুরি হয়ে গিয়েছিল । 

বন্ধুবান্ধবদের বলে দিতে হয়েছিল যে পায়খানায় গেলে সামনেই মগ রেখে দিতে, যাতে জানা যায় যে কেউ একজন ভেতরে বসে ধ্যান করছেন । আমি পাটনামুখো হলে ওরা পাটনাতেও চলে আসতো ।

একবার অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, যারা আমাদের আন্দোলনের পোস্টার প্রচ্ছদ ইত্যাদির ড্রইং এঁকে দিত, ওরা এসে পৌঁছল খন্ডহরে । আমরা তিনজনে ওই বাড়িতে একত্রিত হয়েছি দেখে ত্রিদিবও পৌঁছে গেল । একেবারে খন্ডহর গুলজার । সকালে মুড়ি কাঁচালঙ্কা খেয়ে-খেয়ে কয়েকদিনে চোঁয়াঢেঁকুর আরম্ভ হলে ত্রিদিব আইডিয়া দিল যাওয়া যাক গৌরকিশোর ঘোষের বাড়ি, সকাল-সকাল ।

 গৌরকিশোর ঘোষ থাকতেন বরানগরে । খেয়াঘাটের কাছে আমাদের বসতবাটী থেকে হন্টন দিয়ে বালিখাল, তারপর সেখান থেকে বাস ধরে বরানগর । বালিখাল ধেকে শ্যামবাজার যেত বাসগুলো । সকালের ব্রেকফাস্টটা গৌরকিশোর ঘোষের বাসায় সারা যাবে । তখন বালিখালের ফ্লাইওভারটা তৈরি হয়নি ।

সেসময়ে ‘দর্পণ’ নামে একটা ব্রডসাইড পত্রিকা প্রকাশিত হতো । তাতে আমাদের সম্পর্কে ‘বিদেশি সাহিত্যের নকল’ ধরণের টিটকিরি মেরে খবর বেরোত । প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই বেরোত কিছু-না-কিছু । ঠাট্টা করে কার্টুনও বেরিয়েছিল কয়েকবার । কার মগজ থেকে ওই মন্তব্যগুলো বেরোচ্ছে তা জানার জন্য আমি, দেবী রায়, সুবিমল বসাক আর ত্রিদিব মিত্র ঢুঁ মেরেছিলুম ‘দর্পণ’ দপতরে । গিয়ে পাওয়া গেল না কাউকে । ফতুয়া-লুঙ্গি পরা একজন পাকাচুল ম্যানেজার ছিলেন যিনি অফিস সামলাতেন । তাঁকে আমাদের কয়েকটা বুলেটিন দিলুম সম্পাদকদের পড়তে দেবার জন্য । তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলুম যে কাগজটা শুরু করেছেন যুগান্তর পত্রিকার অমিতাভ চৌধুরী আর আনন্দবাজার পত্রিকার গৌরকিশোর ঘোষ । 

ওনারা দুজনেই খবর পেলেন যে আমরা দলবেঁধে ঢুঁ মেরেছিলুম । অমিতাভ চৌধুরী, বুলেটিনগুলো পড়ে আমরা কী করতে চাইছি অনুমান করলেন, আর পর-পর দুটি সংখ্যা ‘দৈনিক যুগান্তরে’ সম্পাদকীয় লেখালেন ; আমাদের সমর্থন করেই বলা যায় । সম্পাদকীয় দুটো লিখেছিলেন কবি কৃষ্ণ ধর । 

আনন্দবাজারে আমাদের সমর্থনে লেখার প্রশ্নই ওঠেনা । অবশ্য ‘দেশ’ পত্রিকায় জ্যোতির্ময় দত্ত একটা দীর্ঘ তাচ্ছল্য-গদ্য লিখেছিলেন, ‘বাংরিজি সাহিত্যে ক্ষুধিত বংশ’ শিরোনামে , তাতেও সেই একই বক্তব্য, বিদেশি প্রভাব । জ্যোতির্ময় দত্ত এখন আমেরিকায় থাকেন । সম্প্রতি দিল্লির অরুণ চক্রবর্তী আমেরিকা গিয়ে জ্যোতির্ময় দত্তের সঙ্গে দেখা করতে গেলে জ্যোতির্ময় অরুণকে জানিয়েছেন যে ‘হাংরি আন্দোলনই বাংলা সাহিত্যের একমাত্র আন্দোলন’ । মন্দ লাগেনি শুনে !

আসল প্রসঙ্গে ফিরি । গৌরকিশোর ঘোষ আমাকে ওনার বাসায় ডেকে পাঠালেন, সকালে একসঙ্গে রাধাবল্লভি আর আলুর দম খাবার নিমন্ত্রণ জানিয়ে । ওনার বাড়ির কাছে কোনো মিষ্টির দোকানে সকালে লাইন লাগে ওই কম্বিনেশান খাবার জন্যে । সেই সূত্রেই অনিল, করুণা, ত্রিদিবকে নিয়ে ওনার বাসায় ব্রেকফাস্টটা সেরে ফেলবার উদ্দেশ্যে রওনা দিলুম । 

চারজন পৌঁছে গেছি দেখে উনি চ্যাঁচারি ভরা রাধাবল্লভি আর হাঁড়িভর্তি আলুর দম আনালেন । খেতে-খেতে তর্কাতর্কি শুরু হল । গৌরকিশোর ঘোষ শুরু করলেন ওয়াল্ট হুইটম্যান-এর লিভস অব গ্রাস দিয়ে । ত্রিদিব জীবনানন্দে ইয়েটস, বাংলা কবিতায় সনেটের আঙ্গিক, ছোটগল্পের জন্ম ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলল । অনিল-করুণা রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকায় ফরাসি প্রভাব নিয়ে তর্ক জুড়লো । গৌরকিশোর ঘোষ আমাদের নাটকে ‘থিয়েটার অব দি অ্যাবসার্ড’-এর কথা তুললেন । আমি কারোর পক্ষই সমর্থন করছিলুম না । একজন কোনো কথা বললেই, আমি শুধু আলুর দমের প্রসংশা করছিলুম । কী দারুন স্বাদ, এত বড়-বড় কেটেও কত নরম, ভেজে করে না সিদ্ধ করে করে, জ্যোতি না চন্দ্রমুখি, রাধাবল্লভির সঙ্গে রাজযোটক কম্বিনেশান ইত্যাদি বলে যাচ্ছিলুম । সাহিত্য নিয়ে একটি কথাও নয় । রাধাবল্লভি আর আলুর দম খাওয়াবেন শুনে আমি তর্কটার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছিলুম ।

গৌরকিশোর ঘোষ, আমার দিকে তাকালেন , মিটিমিটি হাসি সহযোগে বললেন, ও, বুঝেছি, রূপদর্শীকে গুলগল্পের টেক্কা দিচ্ছ ! গৌরকিশোর ঘোষ রূপদর্শী ছদ্মনামে লিখতেন আর তাঁর সেই লেখাগুলোকে বলতেন গুলগল্প ।

আমি বললুম, হ্যাঁ দাদা, আলু জিনিসটা আমাদের দেশের নয় । আমাদের দেশে আসেওনি বেশিদিন হল । এই কন্দমূলটি পোর্তুগিজরা প্রথম জাহাঙ্গিরের দরবারে উপহার দিয়েছিল । স্পেন যখন ইনকাদের হারিয়ে তাদের দেশটাকে দখল করল তখন তারা লাল আলু নিয়ে গেল ইউরোপে । ইউরোপ থেকে লাল আলু এলো আমাদের দেশে । পর্তুগিজরা পেরু বলিভিয়া থেকে শাদা আলুর প্রচলন করেছিল উপনিবেশগুলোয় । আমাদের দেশে ওয়ারেন হেস্টিংস আলুচাষের ব্যবস্হা করেন । প্রথমে দেহরাদুনে চাষ হতো ; তাই তাকে বলি নইনিতাল আলু ; সেই আলুরই জাতভাই হল চন্দ্রমুখি ।

গৌরকিশোর ঘোষ পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘মক্কেল দেখছি ব্রিফ তৈরি করেই কেস লড়তে এসেছে । ঠিক আছে, পুরোদস্তুর নেমন্তন্ন রইল, পরের বার ফুল কোর্স লাঞ্চ খাওয়াবো ।’

আমার আর যাওয়া হয়নি । পঁয়ত্রিশ মাস ধরে কেস লড়তেই কালঘাম ছুটে গিয়েছিল । 

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

মলয় রায়চৌধুরীর ঝুরোগল্প : সঁইয়া রাত কো আনা রে

সঁইয়া রাত কো আনা রে

 বিহারের বাঢ় শহরে গিয়েছিলুম ইন্সপেকশনে । 

দোতলায় বসে আমি আর আমার অধস্তন অফিসার কাগজপত্র ওলটাচ্ছি, পরীক্ষা করছি, রাস্তার ওপারে সামনের বাড়ির বারান্দায় একজন যুবতী সেজেগুজে নাচা আরম্ভ করে দিল, “অভি না যাও চোদ কর কি দিল অভি ভরা নহিঁ” । 

সামনের দরোজাটা বন্ধ করে দিতে বললেও কারোর কানে গেল না কথাটা । নিজেই বন্ধ করলুম উঠে । শুনতে পেলুম যুবতীটি গাইছে, “সঁইয়া রাত কো আনা রে, মওজ করকে যানা রে”।

লাঞ্চের সময়ে নিচে নেমে একটা ছেঁদো হোটেলে ভাত-ডাল-আলুভাজা খাচ্ছি যখন, পিওনটা এসে ফিসফিস করে বলল, “স্যার ওই রণ্ডিটাকে শাখা অধিকর্তা আগে থেকে শিখিয়ে দিয়েছিল যে আপনারা ইন্সপেকশানে আসছেন,  টোপ ফেলে আপনাদের মন অন্য দিকে ঘোরাতে চেয়েছে, অনেক ঘাপলা আছে শাখায়, চাষিরা এলে তাড়িয়ে দেয়।” 

যে হোটেলে  উঠেছিলুম, সন্ধ্যাবেলা সেখানেও কয়েকটা বেশ্যাকে নিয়ে হাজির । 

বললুম যে “ওই রণ্ডিদের সঙ্গে শুয়েও আমি যা রিপোর্ট করার তাই করব”, তখন শাখা অধিকর্তা হাঁটু গেড়ে হাতজোড় করে কাঁদতে আরম্ভ করল । আত্মম্ভরিতা উপভোগেরও কষ্টের দিক আছে ।

অধস্তন অফিসার ছিল বিহারি । বলল, স্যার, আমাকে তো সুযোগ দিতে পারতেন, ওদের মধ্যে একজন কিন্তু বেশ টইয়াল ছিল ।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান