মলয় রায়চৌধুরীর অনুগল্প : মল, মালটিপ্লেক্স, চোদ্দ শাক

ইনারবিট মলের ফুড কোর্টে বসে অপেক্ষা করছিলুম এক দম্পতির, যাঁরা তাঁদের বিবাহবার্ষিকীউদযাপন করার জন্য আমাদের কয়েকজনকে মেইনল্যান্ড চায়নায় ডিনার করাবেন । নিমন্ত্রিতরা সবাই এসে পৌঁছোয়নি বলে গ্যাঁজাচ্ছি । একজন অচেনা সুশ্রী যুবতী এগিয়ে এলেন ; ভাবলুম তিনিও নিমন্ত্রিত । কিন্তু তিনি আমার কাছে এসে একটা লাল রঙের বই খুলে বললেন, ইংরেজিতেই বললেন,— এই ধরণের মলে ঢুকলে সকলেই দেখি মাতৃভাষা ভুলে যায়—“স্যার, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছেআপনি বাঙালি ; কাইন্ডলি বলুন এই গ্রিনগুলোর ইংরেজি কী? এখানের ভেজি-মার্কেটে কেউ বলতে পারল না ; পাওয়াও যাচ্ছে না কোথাও , আমি ক্রফোর্ড মার্কেটে খোঁজ করেছিলাম, ওরা বলল যে ইনঅরবিট মলে পাবো ।”

আমি বললুম, এটা তো বাংলা পাঁজি ? পাঁজি কোথায় পেলে ? ইনঅরবিট মলে পাঁজিও পাওয়া যায় নাকি ?যুবতী বললে, “না স্যার, ঠাকুর ভিলেজের মাছের দোকান থেকে কিনেছি ।” ঠাকুর ভিলেজ জানি, গ্রাম নয়, উচ্চবিত্তদের এলাকা । নিউ ইয়র্কের গ্রিনিচ ভিলেজ যেমন গ্রাম নয় ।

–মাছের দোকানে পাঁজি ? এই চালুনিও সেখান থেকে কিনেছ ? আজকাল তো আটা চালার ব্যাপারটা উঠেই গেছে ।

–হ্যাঁ স্যার । কয়েকটি মুসলমান ছেলে মেদিনীপুর থেকে এসে মাছের দোকান খুলেছে, তারা বাঙালির প্রয়োজনের সব জিনিস বিক্রি করে ।

মেয়েটিকে দেখে অবাঙালি মনে হচ্ছিল । যদিও সব যুবতীই আজকাল জিনস আর টপ পরে বেরোন । দুহাতে মেহেন্দি আঁকা । এক হাতে দামি ব্যাগ আর একটা চালুনি, অন্য হাতে পাঁজি । দামি পারফিউম লাগিয়ে থাকবে ।

বললুম, তুমি বাঙলা পড়তে পারো না ?

মেয়েটি বসল পাশের চেয়ারে । ব্যাগ আর চালুনি রাখল টেবিলের ওপর । পাঁজিটা মেলে ধরল । বলল, আমি কানপুরের মেয়ে, আমার হাজব্যাণ্ড বাঙালি । চালুনি কিনেছি করওয়া চৌথ অনুষ্ঠানের জন্য, প্লাসটিকের ইউটেনসিলের দোকান থেকে । আর এই রেড বুকে লেখা ফোরটিন গ্রিনস কিনতে বেরিয়েছি আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির জন্য, সেই সকাল থেকে বেরিয়েছি । আমায় কিনতেই হবে, এটাআমার বিয়ের প্রথম বছর; ওনাদের ইমপ্রেস করার জন্য আমি এই ফোরটিন গ্রিনস যোগাড় করবই ।

“পাঁজিতে ফোরটিন গ্রিনস আবার কী জিনিস ?” জানতে চাইলেন আমার একদা এক সহকর্মীর স্ত্রী । সহকর্মীও অবসর নিয়েছেন । পাঁজিটা নিয়ে তিনি পাতা ওলটাতে-ওলটাতে বললেন, কতোকাল পরেবেণিমাধব শীলের পাঁজি দেখছি, বেশ নসটালজিক লাগে । সবায়ের নসটালজিক হাত ঘুরে পাঁজিটা আবার আমার কাছে এলো ; আমার চুলে বেশি পাক ধরেছে বলে সম্ভবত। মেয়েটি যে পাতাটায় পেজ মার্ক দিয়ে রেখেছে, সেখানে ফোরটিন গ্রিনসগুলো হলুদ রঙে হাইলাইট করা ।

সবাইকে পড়ে শোনালুম ফোরটিন গ্রিনসের নামগুলো, যদি কেউ কোনো হদিশ দিতে পারে । ভুত চতুর্দশীতে খাবার জন্য চোদ্দ শাক : ওলপাতা, কেঁউ, বেতো, সরিষা, কলকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা আর সুষণী ।

শুনে, সকলের মুখের মুচকি হাসিতে যুবতীটি বিব্রত বোধ করলে, আমার স্ত্রী মেয়েটির থুতনি ধরে আদর করে বলল, “এই ফোরটিন গ্রিনসের তিনচারটি ছাড়া মুম্বাই কেন তুমি কলকাতার বাজারেও পাবে না । তোমার শ্বশুর-শ্বাশুড়িও এই গ্রিনসের সব কয়টি দেখেছেন বলে মনে হয় না । আমরা কলকাতায় বহুদিন ছিলুম, চোদ্দশাক বাজারে বিক্রি হয় ভুতচতুর্দশীতে, কলমি, পুঁই, পালঙ, নটে, লাউ, কুমড়োশাক কুচোনো, তারসাথে হয়তো দুচারটে নিম আর সুষণী পাতা । উত্তরপাড়ার বাজারেআমার গোঁড়া শ্বশুরমশায়ও খুঁজে পাননি কখনও । আমি তো এই প্রথম শুনছি শাকের নামগুলো ।আমার শ্বাশুড়িও ভুতচতুর্দশী করতেন, ফোরটিন গ্রিনস দিয়ে নয়, দুতিনরকম শাকের চোদ্দ টুকরো । যা শাক পাও কিনে শ্রেডিং করে নাও, ব্যাস, ইয়োর ইনলজ উইল বি হ্যাপি ।”

আমার সহকর্মীর স্ত্রী, এক সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন, বললেন, রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দেও বোধহয় এই গাছাগাছালির নাম নেই ।

আমি ভাবছিলুম, ভুতচতুর্দশিতে যে এই শাকগুলো খেতে হয় তা-ই তো জানতুম না ।

About anubadak

আমি একজন অনুবাদক । এতাবৎ রেঁবো, বদল্যার, ককতো, জারা, সঁদরা, দালি, গিন্সবার্গ, লোরকা, ম্যানদেলস্টাম, আখমাতোভা, মায়াকভস্কি, নেরুদা, ফেরলিংঘেট্টি প্রমুখ অনুবাদ করেছি ।
This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান