মলয় রায়চৌধুরীর ঝুরোগল্প : গাধার জেব্রার রূপ ধারণ

সকালবেলার তন্দ্রাচ্ছন্ন গোরস্তানে, কালো হোসপাইপ-লিঙ্গ ঝুলিয়ে-দুলিয়ে দৌড়োচ্ছিল গাধাটা । এখনকার পেণ্ডুলাম । যেন সময়ের কন্ঠস্বর । সুযোগ পেলে হড়হড় করে ঝরবে বিদ্রুপ । কান নাচিয়ে দৌড়।গাধাটার ডাকে এমন তীব্র স্বরাঘাত ছিল যে মনে হচ্ছিল পুরো সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা’র ভাঙা আয়নার টুকরো-টাকরা দিয়ে সাজানো । আতঙ্কের বিস্ফোরণে গাধাটা, যার অভ্যাস শুধু ধোপার ধাতানি খাওয়া, সমবেত লোকগুলোকে এড়িয়ে দৌড়চ্ছিল , ছায়ায় গলতে থাকা একটা আকৃতি, যার ফাঁপা ডাকের মোড়ক ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে সূর্যের আলো, উত্তেজনার অবরোহণের আদল-আদরায় ।

গাধার গায়ে, একদিকে, আরবি বা ফারসি বা উর্দুতে কিছু লেখা, আলকলাতরা দিয়ে । বারান্দা থেকে গরিব লোকেদের মারামারি দেখে আঁচ করলুম ব্যাপারটা হিন্দু-মুসলমানের নয়, কেননা গাধাটার গায়ে উর্দু, বা ফারসি কিংবা আরবি হরফে আলকাৎরা দিয়ে কয়েকটা শব্দ লেখা  । আব্রাহামিক বিশ্বাসের মানুষেরা লিখে রাখা অক্ষরকে ভয় পায়, ক্যাথলিক স্কুলে পড়ার সময়ে টের পেয়েছিলুম । 

জাল-বসানো ঘন নীল ভ্যান থেকে নেমেই  জন-পনেরো পুলিশ  তাড়া করে ধরতে লাগলো ধুলোটেলাঠি  আর জংধরা তরোয়ালধারী লোকগুলোকে, যারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল । তরোয়াল উঁচিয়ে গাধাটার দিকে দৌড়োচ্ছিল লুঙ্গিপরা রোগাটে একজন দাড়িয়াল প্রৌঢ়, যার লুঙ্গিতে পুলিশের টান পড়তেই উলঙ্গ হয়ে সে তরোয়াল ফেলে দিয়ে অসাড় আতঙ্কের গ্রাসে পড়ে দু’হাত দিয়ে নিজের লিঙ্গের নগ্নতা সামলানো জরুরি মনে করলো । কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে লুঙ্গিটা  পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো কনসটেবল । ল্যাংটো অবস্হাতেই, ঢুকতে না চাইলেও,  পুলিশ তাকে ভ্যানে ঢোকালো, লোকটার পোঁদে সূর্যের আলো পড়ে তামার খাদ মেশানো সোনার মতন ঝিলিক মারছিল, যেন লোকটার দুঃখের জানালার সামান্য ফাটল থেকে ছড়িয়ে-পড়া আলো । অনেক সময়ে সেই সব মানুষের পোঁদও তাদের অভিব্যক্তির  আয়না হয়ে ওঠে, যাদের মাতৃভাষা হলো টাকাকড়ির খাঁকতি, অন্নের অভাব । কোনো ভয় খিদের সামনে টিকতে  পারে না, কোনো ধৈর্য তা শেষ করতে পারে না, যখন খিদে আর সামলানো যায় না তখন ঘৃণাও কাজে লাগে না, আর একজন লোকের খিদের সামনে কুসংস্কার, বিশ্বাস আর নীতি স্রেফ অস্তিত্বহীন । নগ্নতার কথা আলাদা, সম্ভবত ।

বন্দুকের কুঁদো আর লাঠির মার দিয়ে পুলিশ  যে কজনকে পাকড়াও করতে পারলো,  নিয়ে গিয়ে ঢোকালো ভ্যানে। একজন কনসটেবল গাধাটার কান দুটো ধরে, আরেকজন  পেছনে লাথি মেরে-মেরে ঢোকালো  । পুলিশকে অবজ্ঞা করে, গাধাটাই শুধু ঢুকতে আপত্তি করল না, বিশাল কালো লিঙ্গ ঝুলিয়ে আর দুলিয়ে ভ্যানের ভেতরে চলে গেল ! গাধার ডাক থামতেই ভারি আর আরামদায়ক স্তব্ধতায় ছেয়ে গেল কয়েকশো বছরের পুরোনো গোরস্তানের খণ্ডহর। 

পাড়ার ধোপা গাধাটাকে যখন থানা থেকে ফেরত আনলো, দেখলুম যে উর্দু বা আরবি বা ফারসি লেখার ওপরে আলকাতরা বুলিয়ে তাকে জেব্রা করে ফেলা হয়েছে, মারামারি থামাবার জন্য ।

About anubadak

আমি একজন অনুবাদক । এতাবৎ রেঁবো, বদল্যার, ককতো, জারা, সঁদরা, দালি, গিন্সবার্গ, লোরকা, ম্যানদেলস্টাম, আখমাতোভা, মায়াকভস্কি, নেরুদা, ফেরলিংঘেট্টি প্রমুখ অনুবাদ করেছি ।
This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান